উপহার
পর্ব ১
রাত প্রায় তখন আড়াইটা। ঘুমাচ্ছিল নাইম। ফোনটা একটানা বেজেই চলছে। শোয়া থেকে উঠতে হবে। কিন্তু ক্লান্ত শরীর সাঁই দিচ্ছিল না। পাশ থেকে নীলুফা উঠে বলল,
-ফোনটা ধর!!কতক্ষণ ধরে বেজে চলছে!!!
-একটু। উঠছি।
হাতড়ে চশমাটা খুঁজে বের করল।কাঁপতে কাঁপতে ল্যাপের নিচ থেকে বের হল। শীতটা এইবার বেশি পড়ছে। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিল। মোবাইলটা নিয়ে রিসিভ করল।
-হ্যালো।
-নাইম সাহেব বলছেন??
-জ্বি।
-সাইফ উদ্দিন আপনার কে হন???
-আমার বন্ধু!!!
-আপনার বন্ধু এক্সিডেন্ট করেছে।উনার স্ত্রীর স্পট ডেড।উনারও খুব খারাপ অবস্থা!!আপনাকে খুঁজছিলেন!!
---------------
দশ বছর পূর্বে
প্রায় কাকভেজা হয়ে হাসপাতালে ঢুকল নাইম। রিসিপশনে গিয়ে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
-জনাব হুমায়ুন চৌধুরী। খানিক আগে আনা হয়েছে। হার্টের রুগী। বয়স প্রায় ৮০।আসলে এই মাত্র আনা হয়েছে।সাথে একজন বছর চল্লিশের মহিলা।
-ও!!! এইমাত্র আনা হয়ে থাকলে উনি ইমার্জেন্সিতে আছেন।
-থ্যাংকস।
ইমার্জেন্সিতে এসে দেখল হুমায়ুন চৌধুরী শুঁয়ে আছেন। চোখ বন্ধ।বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন। ডাক্তার চেক করছেন।দ্রুত উনার পাশে গিয়ে বলল,
-ইজ হি ওকে ডক্টর?? সেভ হিম, প্লিজ। হি ইজ মাই অনলি রিলেটিভ।
গলা ভেঙ্গে গেছে নাইমের। কান্না করছে।
-প্লিজ। হি ইজ ওকে। ডোন্ট বি আপসেট। বুড়ো হয়েছেন। স্রেফ বার্ধক্যজনিত সমস্যা। আপনি কে হন??
-আমি উনার নাতি।
-ঘাবড়াবার কিছু ঘটে নি। স্রেফ লো প্রেশার। আপনি আমার রুমে আসুন।
বলে ডাক্তার তার রুমের দিকে হাঁটা দিল। দাদার পাশে এসে হাতটা ধরল নাইম। ধীরে ধীরে চোখ খুললেন তিনি।
-দাদা তোমার কিছু হয় নি। ইউ আর গুড।
বলে হাসল সে। দাদাও হাসল সামান্য করে। দাদার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল সে।উনার চোখ চল চল করছে। তারপর কানের কাছে মুখটা নিয়ে বলল,
-আমি আসছি দাদা। ডাক্তারের সাথে সামান্য কথা বলতে হবে।
তারপর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পেছনে ভয়ার্থ মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার দিকে তাকাল সে। ভয়ার্থ মহিলার নাম আলেয়া বেগম। তাদের বাড়িতে কাজ করে। উনার দিকে ফিরে সে জিজ্ঞেস করল,
-কি হয়েছিল, খালা??
-টিভি দেখছিল। হঠাৎ দেখলাম নাচা শুরু করল। তারপর ধুম করে পড়ে গেছে।
-নাচা শুরু করছে!!! কি বলেন!!!
-হ্যা!!!
আশ্চর্য হয়ে প্রশ্নবোধক চেহেরা নিয়ে দাদার দিকে তাকাল সে। দাদা মুচকি হেসে চোখ টিপে দিল।চোখে চল চল ভাবটা নেই। করুণ চেহেরাটাও নাই। স্রেফ কৌতুক মাখানো হাসিটা আছে। মাথা নাড়তে নাড়তে সে হাঁটা দিল ডাক্তারের রুমের দিকে।
ডাক্তারের রুমে ঢুকেই দুটা জিনিস নজর কাড়ল তার।একটা, ডাক্তারের পেছনের দেয়ালে বিশাল এক ছবি ঝুলছে। শেক্সপিয়ারের ছবি!!! ডাক্তারের রুমে শেক্সপিয়ারের এত বিশাল ছবি!!
আরেকটা ডাক্তারের সামনের সীটে হাতা কলম নিয়ে বসে থাকা সুন্দরি। ডাক্তার বলল,
-বসুন।আমি ডাঃ জাহেদুল আলম।কার্ডিওলজিস
-আমি নাইম চৌধুরী। কিন্তু আপনি ইমার্জেন্সিতে ছিলেন। ভাবছিলাম জুনিয়র ডাক্তার।
-আসলে খুব একটা ডাক্তার নাই।ছুটিতে প্রায় সবাই। আর আমি ঐখান দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম দেখি। আর ঐ মহিলা, কি যেন নাম!!! হার্টের রুগী রুগী বলে চিৎকার করছিল। উনি ভয় পেয়েছেন খুব।বাই দ্যা ওয়ে, আপনার দাদার কিরকম হার্ট প্রবলেম??
-ইতিমধ্যে একটা রিং লাগানো হয়ে গেছে। এনিথিং সিরিয়াস??
-না, না। দেখে তা মনে হয় নি। মাথায় একটু ব্যাথা পেয়েছেন। ইট উইল বি অলরাইট।
-উনাকে দুএকদিন এইখানে রাখলে কি ভাল হবে?
-আসলে খুব একটা দরকার নাই। যদি আপনি চান তো থাকতে পারে।
-থাকলে হয়ত ভাল হবে।
-আপনার মর্জি।
২
দুদিন পর দাদাকে নিয়ে বাড়ি চলে আসল নাইম। এর মাঝে নীলুফার সাথে টুকটাক কথা হত। অবশ্য সবই দাদার অসুস্থতা, ওষুধই।কথা কম হলেও পাশে বসে থাকত দুজন। কিছু বলবে বলবে করেও বলা হয় না নাইমের। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তে তাকিয়ে থাকে নীলুফার দিকে। সুন্দর কিন্তু কটমট চেহেরার দিকে অজান্তে খুঁজে কিছু। হঠাৎ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। মনে পড়ে অনেক আগের কথা, এভাবেই পাশে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকত একজনের দিকে। হঠাৎ ঐ স্মৃতি মনে পড়ে। হয়ত বিষণ্ণতা আঁকড়ে ধরে। উঠে চলে যায় নীলুফার সামনে থেকে। নীলুফা জানে হঠাৎ, নাইম তাকে দেখে। কেমন ঘোর লাগা চেহেরায় তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়।
আর ডাঃ জাহেদ ভদ্রলোক, চমৎকার মানুষ। শেক্সপিয়ারকে পছন্দ করেন।নাইমের সাথে প্রায় সময় দেখা হলেই শেক্সপিয়ারকে নিয়ে আলাপ জুড়ে দেন।
হাসপাতাল থেকে চলে আসার তিনদিন পর, রাতে বাড়ি ফিরল নাইম। সাড়ে দশটা নাগাদ। দেখে, হুমায়ুন চৌধুরী ফুটবল খেলা দেখছেন। আর চিল্লাচ্ছেন। আর্সেনাল কোচ ওয়েঙ্গারের গুষ্টি উদ্দার করছেন। চেহেরায় আক্রমণাত্মক ভাব। নাইম মৃদু হেসে, ফ্রেশ হয়ে দাদার পাশে এসে বসল।
-কি করছ বলতো। কয়টা বাজে এখন?? খেয়েছ?
-আরে খাওয়ার টাইম আছে! দেখ, এইভাবে কেউ খেলে? এম্বিশনহীনভাবে খেলছে। কোচের কোন প্ল্যানও নাই।
-দাদা, আর্সেনাল গত বারেও চ্যাম্পিয়নস লীগ ফাইনাল খেলেছে।
-তো!! ভাল কথা, নীলু আসছিল।
-নীলুটা কে??
-ঐযে, ডাক্তারের মেয়েটা, সুন্দর করে
-কেন আসছিল??
-এমনি। এদিকে এক বান্ধবীর বাড়ি আসছিল নাকি।
-ঠিকানা কিভাবে জানে??
-আমি দিয়েছিলাম।
- তুমি কেন??
-কেন মানে!!! আরে ভাল মেয়ে। পরেরবার নাচতে গিয়ে যদি পড়ে যায়, তাহলে ওকে ফোন দিলেই হবে। আলেয়ার ঘ্যান ঘ্যান শুনতে হবে না।
-শো সাম রেস্পেক্ট, দাদু! উনি না থাকলে তোমার ঐদিন কি হত?
-হইছে বলতে হবে না। আচ্ছা, আরেকটা ভাল কথা, তুই বিয়ে কখন করছিস রে??
-দাদা, প্লিজ। এখন না।
-তাহলে কখন??আমি মরার পর!!
-মানে কি, এসব বলার!! রাত অনেক হয়ছে। চল খেয়ে, ঘুমাবে ।
-কয়টা বাজে??
-প্রায় এগারটা।
- রাত তো সবে শুরু হয়ছে।
অনেক যুদ্ধ করে রাত প্রায় বারটার দিকে বিছানায় নিতে পারল দাদাকে। লাইটটা বন্ধ করে, নিজের রুমে চলে যাবে, এমন সময় দাদা বলে উঠল,
-কালকে রাতে কখন ফিরবি??
-কেন??
-এমনি। জাস্ট জিজ্ঞেস করছি।
-তাড়াতাড়ি ফিরব। তেমন কাজ নাই।
-হুম। তো তোর প্রোডাকশন হাউজ কেমন চলছে??
-ভালই। খুব ভাল। ভাল ভাল কাজ পাচ্ছি।
-হুম। তাড়াতাড়ি ফিরিস।
-এনিথিং স্পেশাল??
-আরে না। ভাবছি, দুজনে মিলে রাতে খাব একসাথে। কি বলিস??
-আচ্ছা।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের রুমে আসল নাইম। ফ্রেশ হয়ে শুঁয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ আগে দাদুর সাথে খুনসুটি গুলা ভাবছে। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে বাবা মাকে দেখেনি সে। এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল তার বাবা মা। তিনিই তাকে বড় করেছেন। মা -বাবা দুটার দায়িত্বই পালন করেছেন। দাদীকেও খুব একটা মনে পড়ে তা না। তবে পড়ে মাঝে মাঝে। ক্লাস ফাইভে থাকতে মারা যান তিনি। আগের মতই আছেন হুমায়ুন চৌধুরী । কখনো কাঁদতে দেখেনি, নাইম, তার দাদাকে। সবসময় হাসিখুশি। দাদার কাছে জানতে চেয়েছিল সে, বাবা মা মারা যাওয়ার মৃত্যু দিনটা! বলেনি। জবাব দিত,
-কি হবে মনে রেখে। আমিই তো ভুলে গেছি। এসব মনে করে খামোকা মন খারাপ করবি কেন!! মন খারাপ করলে তো আর কেউ ফিরে আসবে না। যে গেছে, সে যাক। যত মনের ভিতর আঁকড়ে রাখবি, কিছু পার্থিব সংখ্যার উপর নির্ভর করে মন খারাপ করবি, সামনে আগাতে পারবি না। আমি মনের মধ্যে আঁকড়ে ধরলে তোকে হয়ত ভালভাবে গড়ে তুলতে পারতাম না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করে। ঘুম আসে না। উঠে বসে। টয়লেটে গিয়ে মুখে পানি দেয়। পানি খায়। খাটে এসে বসে পড়ে। মাথাটা অস্থির লাগছে। বুক কাঁপছে। চোখে বন্ধ করলেই ভেসে উঠছে, নাফিসার চেহেরা। মাথাটা ঝাকায়।ঝেঁড়ে ফেলতে চেষ্টা করে পুরনো স্মৃতি।কিন্তু পারে না। বার ভেসে উঠে, তার নাকে তুলো দেয়া প্রশান্তিতে ঘুমানোর দৃশ্যটা। সেদিনও ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে ছিল সে। একদৃষ্টিতে!!
৩
পরদিন খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে নাইম। আটটার দিকে। চাবিটা ভুলে ফেলে গিয়েছিল। তাই দরজা নক করতে হয়। দরজা খুলার পর ওপাশে তাকিয়ে অবাক হয়। নীলুফা!!!
-আপনি??
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে নাইম।
-আগে ভিতরে আসুন। তারপর নাহয় বলি।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করল নাইম। ড্রয়িং রুমে দাদা আর ডাঃ জাহেদুল আলম আর নাইমের ফ্রেন্ড সাইফ।
নাইমকে দেখে সাইফ বলল,
-আরে নাইম। কি অবস্থা?? অনেকদিন পর দেখা।
-তুই চিটাগাং কখন এলি?? আমিতো বাড়িতে ঢুকার পর থেকেই চমকের উপর আছি।
জবাব দিল নাইম।
-হ্যা। আসার পরই তো ফোন দিলাম দাদুকে।
বলল সাইফ।
দাদার দিকে ফিরল নাইম।
-এইটা কি ছিল?? আমাকে একটু জানালেও না!
-সারপ্রাইজ ছিল। সারপ্রাইজ আগে থেকে কেউ জানে না। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, ইনি ডাঃ......
-আমি চিনি। আগেই পরিচিত হয়েছি। (ডাক্তারের দিকে ফিরে) কেমন আছেন আপনি??
-এইত ভাল। তোমার কি অবস্থা???
-ভাল। বাট সারপ্রাইজড।
দাদা বলে উঠল,
-তোমার পেছনের জন, ডাঃ নীলুফার আলম। আর তার পেছনের জন্ তোমার বন্ধু জনাব সাইফের বাগদত্তা এবং তোমার বাচ্চাকালের বান্ধবী নাবিলা!!!
-নাবিলা!!! কখন আসলি??
নাবিলা জবাব দিল,
-সাইফের সাথেই আসলাম।আর কার সাথে আসব!! দুপুরের দিকে।
খানিক পরে সবাই মিলে খেতে বসল। খাওয়া শেষ হওয়ার পর। ছেলেরা ড্রয়িংরুমে আড্ডা দিচ্ছিল আর নীলুফা আর নাবিলা, আলেয়া খালাকে রান্না ঘরে সহায়তা করছিল।
নাইমঃ আমাকে বলা উচিত ছিল দাদু।
দাদুঃ আমি সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।
নাইমঃ বুঝতে পারছি। তো, সাইফ চিটাগাং হঠাৎ??
সাইফঃ ছুটি পেলাম। ভাবলাম দাদুর সাথে এসে কয়েকদিন থাকি।
নাইমঃ আর নাবিলাও একই সাথে ছুটি পাইছে নাহ! বিয়ে করছিস না কেন? (হেসে বলল নাইম)
সাইফঃ বিয়ে করার জন্যই তো আসলাম। (চোখ টিপে বলল সাইফ)
সবাই হেসে উঠল। সাইফ আর নাবিলা দুজনেই বড় হয়েছে অর্পানে। খানিক বড় হওয়ার পর দেখা তাদের নাইমের সাথে। হুমায়ুন চৌধুরী তিনজনকেই নিজের নাতি নাতনীর মত করে দেখতেন, দেখেন। এখন তারা দুজনেই ঢাকায় চাকরি করে এবং চিটাগাং আসলে নাইমদের বাড়িতেই থাকে।
খানিক পড়ে, ডাঃ জাহেদুল আলমের জরুরী কল আসল। উনার যেতে হবে।
জাহেদঃ আচ্ছা, হুমায়ুন চাচা আমার উঠতে হবে।
হুমায়ুনঃ এখনই। আরে কি বল!! আড্ডা সবে শুরু হল।
জাহেদঃ না, যেতেই হচ্ছে।
হুমায়ুনঃ তাইলে কাজ শেষ করে এসে পড়। বাড়ি বড় আছে। থাকতে সমস্যা হবে না।
জাহেদঃ কি যে বলেন!!! সকালে আবার হাসপাতালে যেতে হবে।
হুমায়ুনঃ তাহলে নীলুফা থাকুক।
নীলুফাঃ না দাদু, আমারো যে হাসপাতালে যেতে হবে!!
হুমায়ুনঃ তুমিও কি এখন চলে যাবে নাকি!! তুমি থাক। তোমাকে নাইম পৌঁছে দিয়ে আসবে।কি বলো জাহেদ??
জাহেদঃ হ্যা। থেকে যাও। ঘন্টা দুয়েক পরে নাহয় আসলা বাড়িতে। অথবা আমি যাওয়ার সময় তোমাকে পিক করে নিব অথবা নাইম তো আছেই, নয়তো সে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
নীলুফা কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ল। নাইম আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, নীলুফার চেহেরা লজ্জায় আরক্ত হয়ে গেছে। না, লজ্জায় আরক্ত হওয়ার মত কিছু ঘটে নি!!! এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নীলুফার দিকে তাকিয়ে রইল। সে বুঝতেছে এইভাবে তাকানো উচিত হচ্ছে না, কিন্তু কানের পাশের তিলটা, মাথা থেকে নেমে আসা এক গুছা চুল মুখের উপর থেকে সরিয়ে কানের পিছনে নিয়ে যাওয়াটা তাকে বাধ্য করছে তাকিয়ে থাকতে। তার লজ্জাহীন ভাবে তাকিয়ে থাকাটা ভাঙ্গল ডাঃ জাহেদের কথায়।
-আসি তাহলে নাইম। আবার দেখা হবে।
নাইম খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সম্বিত ফিরে পাওয়ার মত হয়ে বলল,
-অ!!! হ্যা, অবশ্যই। আবার দেখা হবে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলেন তিনি।
ডাঃ জাহেদ যাওয়ার আধঘন্টা পর নীলুফার দিকে আবার তাকাল নাইম। এই আধঘন্টার মাঝে একবারো তার দিকে তাকায় নি সে।কথাও খুব একটা বলেন নি। আর হুমায়ুন একটানা বক বক করেই চলছেন। ইংল্যান্ডে থাকা থেকে শুরু করে, আর্সেনাল ক্লাব নিয়ে ক্রেজিনেস, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, দেশীয় রাজনীতি, এই বছর ফিফা বর্ষসেরা কে হবে কিছুই বাকি রাখছেন না!!! এই বয়সে এত কথা কিভাবে তিনি বলতে পারে, তাই ভাবছে নাইম। তার কথার মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে সাইফ, নাবিলা আর নীলুফা আছেই। নাইম শুনছে না, সে একটা ঘুরে আছে। নীলুফার কানের পাশের তিল আর মাথা থেকে নেমে আসা এক গুচ্ছ চুল। বার বার তাকাচ্ছে। হাসপাতালে থাকার সময় দেখে নি কেন ভাবছে! হঠাৎ সে আবিষ্কার করল, নীলুফাও তার দিকে তাকায় আছে। বুকটা ধ্বক করে উঠল। কি না, কি মনে করছে কে জানে!
৪
ঘন্টা দেড়েক পরে
নীলুফাকে গাড়িতে নিয়ে রাস্তায় নামল নাইম। তারা কথা বলে নি একফোঁটাও। স্রেফ আড়চোখে নীলুফাকে দেখছিল। মাঝে মাঝে নীলুফাও দেখছিল।
কয়েকবার চোখাচোখিও হয়েছে । এখন গাড়িতেও খুব একটা কথা বলছে না। চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে নাইম আর চুপচাপ বসে আছে নীলুফাও।
খানিক পরে নিরবতা ভাঙ্গল নীলুফা।
-দাদু, চমৎকার মানুষ। এই বয়সেও দারুণ আসর জমাতে পারেন।
-হ্যা।
-আপনি অবশ্য খুব একটা কথা বলেন না মে বি!
-না, তেমনটা না।
-তাহলে! খুব চুপচাপ দেখলাম।
-না এমনি!!!আচ্ছা, তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?
-কি!!!
আশ্চর্য হয়নি নীলুফা। নাইমের চোখ দেখেছে। অনেক বছর আগে একজনের চোখে দেখেছিল, ওরকম কিছু!! কিন্তু হয়ে উঠে নি। ঐরকম চোখ সহজে কারো হয় না, যদি ডুবে না পড়ে। ভাসা ভাসা, ঘোলাটে কিছু না। ঐ চোখে স্পষ্ট শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু এইভাবে এত তাড়াতাড়ি প্রশ্নটার সম্মুখীন হবে ভাবে নি।
-কি! না কিছু না। বাদ দেন।
বলল নাইম।
-না। নেই। হয়ে উঠে নি।
-কাউকে পছন্দ করতেন??
-করতাম। অনেক আগে। আপনার??
-ছিল। নেই এখন। বছর পাঁচেক হল।
-হুম। তো, শুনলাম প্রোডাকশন হাউজ আছে?
-ঐটা শখের বসে করা। কিন্তু ভালই কাজ পাচ্ছি। মূল ব্যবসাতেই মনোযোগ দিতে পারছি না। ভালই কাটছে।
-তো, ব্যবসা করবেন? নাকি প্রোডাকশন হাউজ নিয়ে বিজি থাকবেন?
-দুটাই চালিয়ে যাব। কি হয় দেখি!!!
-সবসময় দুই নৌকায় পা দিতে পছন্দ করেন??
-মানে?
-মানে কিছু না। বলছিলাম, দুটা কাজ একসাথে করতে পছন্দ করেন কিনা!
-দুটা কাজ একসাথে করতে পারলে অবশ্যই করি কিন্তু কাজ ভিন্ন হতে হয় আর কি!
বলে খানিক হাসল সে। নীলুফাও হাসল। তারপর বলল,
-কফি খাওয়াতে পারবেন? মাথা ধরেছে আমার।
-কফি! হ্যা অবিশ্যই। সামনেই একটা দোকান আছে।
কফি শপে গিয়ে বসল তারা দুজন। কফির অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। কথা বলছে না। নীলুফা কিছু বলতে গিয়েও বলছে না। নাইম বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল,
-কিছু বলবেন?
-হুম। বলতে চাচ্ছি। কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছিলাম না। আপনি সহজ করে দিলেন।
-বলুন। শুনি।
-আপনার কি মনে হয়, এসব দেখা হওয়া, ডিনারে ডাকা, আপনাকে, আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলা এসব কি কোন রিজন ছাড়াই ঘটছে?
-কোন রিজন আছে?
-অবশ্যই আছে। আমার বাবা ডেস্পারেট!!
-কিসের জন্য?
-আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য। তেমনি নিশ্চয় দাদুও! বুঝলেন তো দুই ডেস্পারেট মানুষ একসাথে হলে কি করতে পারে!
-কি করতে পারে?
-আচ্ছা, আমার কি সবকিছু ভেঙ্গে বলতে হবে? লজ্জার মাথা ভেঙ্গে এই পর্যন্ত বললাম, তাতে কি যথেষ্ট না!
-হ্যা। তা অবশ্য ঠিক। তো কি ভাবছেন?
-কি ভাবব??আমি আপনাকে চিনি কতদিন হল?
-এক মাসও হয় নি।
-আপনি চান, অপরিচিত কারো সাথে এইভাবে হুট করে বিয়ে করতে?
-এইখানে হঠাৎ আমার বিয়ের প্রসঙ্গ আসল কেন!
হতাশ চোখে নাইমের দিকে তাকাল নীলুফা। এর মাঝে কফি চলে আসল। কফি নাড়তে নাড়তে দেখছে নাইমকে। বোকা বোকা ভাবটা চেহেরায় ধরে রেখেছে। খানিক পরে চোখ তুলে তাকাল নীলুফার দিকে। নীলুফা তাকিয়ে আছে দেখে হেসে ফেলল।তারপর বলল,
-স্যরি, ফাজলামো করছিলাম। শুরু করেন, কি বলছিলেন! আমি অবশ্যই অপরিচিতা কাউকে বিয়ে করব না। আপনি কি অপরিচিতা?
-আপনার কি মনে হয়? শুধু একজনের নাম জানলে তার সাথে কয়েক ঘন্টা কথা বললেই পরিচিত হয়ে যায়? মানুষটা সম্পর্কে জানা যায়?
-যাকে চিনতে পারা যায়,বুঝতে পারা যায়, তাকে কয়েক মিনিটে বুঝা যায়। আর যাকে বুঝা যায় না, তাকে সারাজীবনেও বুঝা যায় না।
নীলুফা তাকাল, নাইমের দিকে। হাসল একটু করে । কফিতে বড় একটা চুমুক দিল। নাইম মৃদু হাসছে। নীলুফা চোখ নামিয়ে রেখেছিল কিছুক্ষণ। চোখ তুলে, হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল,
-আমার সাথে কথা বলে কি মনে হল?
-বাড়িতে একরকম, আমার সাথে কথা বললার সময় অন্যরকম, আর হাসপাতালে একেবারে অন্যরকম। বুঝতে পারছি না আসলে। বুঝা কঠিন। আমাকে??
-সো প্রেডিক্টেবল।ফা
-দেখা যাক, কতটা প্রেডিক্টেবল!
-সো, যাকে বুঝতে পারেন না, তার সাথে ঘর করতে নিশ্চয় টাফ হবে!
-তাই? আমার তা মনে হয় না, প্রতিদিন নতুন কিছু আবিষ্কারের মাঝে আনন্দ আছে। বিরক্তি ব্যাপারটা থাকবে না।
-ইন্টারেস্টিং। আর অপরজন যদি আগে থেকেই বুঝে ফেলে আপনাকে, তাহলে তো তার বিরক্তি চলে আসতে পারে। আগেই বলেছি, আপনি সো প্রেডিক্টেবল।
-বিরক্তি আসবে যদি, প্রেডিক্টেবলনেস
-(হাসি হাসি মুখ নিয়ে। চোখ নাচিয়ে) আমরা কার কথা বলছি??
-আমার সামনে যিনি বসে আছেন এবং ক্ষণে ক্ষণে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন।
-আপনি বলছেন, সে প্রেডিক্টেবলনেস
-হয়ত।
-যদি ভুল হয়?
-তাহলে বুঝব, সে যার মাঝে প্রেডিক্টেবলনেস
-কফি শেষ?
-ইয়াহ।
-তাহলে আজকের আলোচনা এখানেই শেষ করি। আবার অন্য কোন এক সময়।
-শেষ! আমরা চাইলে ফোনেও আলাপ করতে পারি বিষয়টা নিয়ে।
-হুম। করা যায়। বাট আমার মনে হয় না, করা উচিত।
-এজ ইউর উইশ। চলুন তাহলে।
গাড়িতে উঠে বসল তারা। দুজনই হাসছে। নীলুফার চোখ আগের চেয়ে উজ্জ্বল হয়েছে যেন।নাইম বুঝতেও পারছে না, কি ঘটছে। হাসতে হাসতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। কফি খেতে খেতে এইভাবেই তো হাসত একজনের সাথে। গাড়িতে এইভাবে বসিয়ে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসত। কথা বলত। দেখত একজন আরেকজনকে। কিন্তু এখন। নীলুফা খেয়াল করল। আগেও অনেকবার করেছে। কথা বলতে বলতে, হঠাৎ চুপ হয়ে যেত নাইম। তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ উঠে চলে যেত। হাসিমাখা মুখটা গম্ভীর হয়ে যেত।হয়ত কোন স্মৃতির কথা মনে পড়ে যায় তার। হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
-কে সে? কি হয়েছিল?
রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করায় নাইম। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে নীলুকে। হাসার চেষ্টা করে। ঠোঁটফাটা হাসি।
-বুঝলাম না।
-আমি কি বলছি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। কে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করল। সে চাইলেই না বলতে পারে, নীলুকে। বলবে কে? চোয়াল শক্ত করে ফেলল। গাড়ি আবার স্টার্ট দিতে গিয়েও থামিয়ে ফেলল। কিন্তু এইভাবে কতদিন আর! গাড়ির বনেটে জোরে ঘুষি মারল। মাথা নীচু করে ফেলেছে।
চমকে উঠল নীলুফা। ভয় পেল। কিন্তু নাইম যখন মাথাটা তুলল, তখন তার বুকটা হু হু করে উঠল। কান্না করছে নাইম। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বুকের সব কষ্ট যেন ভেসে উঠছে চোখ দুটোতে। হাতটা বাড়িয়ে চুলটা পিছনে সরিয়ে দিল নীলুফা। নাইমের চোখে চোখ রেখে বলল,
-কিচ্ছু বলতে হবে না। আমি আর জিজ্ঞেস করব না।
-না। বলতে হবে। এই কষ্ট বয়ে বেড়ানোটা খুব যন্ত্রণাদায়ক। গত পাঁচ বছরে ঘুমাতে দিচ্ছে না। হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি তাকে। হঠাৎ করে। রাতে শোয়ার সময় কথা বলে শুঁয়েছিলাম। সকালে উঠে শুনি সে নেয়। চলে গেছে আমাকে ছেড়ে। শ্বাস কষ্টের রুগী ছিল। রাতে হঠাৎ বুকে ব্যাথা উঠে। ইনহেলার খুঁজে পায় নি। ঐদিন কেউ ছিল না বাড়িতে তাদের। ছোট ভাইটা ছাড়া। কথা শুনত না আমার। কতবার বলেছি ইনহেলার কাছে রাখিও, কাছে রাখিও!! না, সে শুনবে না আমার কথা।
কাঁদছে শিশুর মত নাইম। চোখ মুছে দিল তার। কাঁদতে দিল তাকে। অনেকক্ষণ পর স্বাভাবিক হল সে। নিজেকে সামলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে পারছে না। এইভাবে কান্না করা উচিত হয় নি। কোনমতে বলল,
-স্যরি।
-না, না। সমস্যা নেই।
-আসলে অনেক হালকা লাগছে। দাদু বার বার নিজেকে মুভ অন রাখতে বলে। পারি না। পারছি না। কিন্তু এইবার সত্যি সত্যিই সামনে আগানোর চেষ্টা করছি। সাহায্য করবা আমাকে?
-দেখা যাক। আমাদের আলোচনা এখনো শেষ হয় নি।
বলে হেসে দিল নীলুফা। মুচকি হেসে দেখছে তাকে, নাইম। দেখতে দেখতেই গাড়ি স্টার্ট দিল।
খানিক পরে নীলুফার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল গাড়ি। গাড়ির স্টার্ট থামিয়ে বসে রইল, নাইম। নীলুফাও কিছু বলছে না। চুপ করে বসে আছে। হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলুফা বলল,
-খুব ছোটবেলায় মাকে হারাইছি। বাবা মানুষ করেছে। উনার কেউ নেই। একাই থাকি, দুজন মানুষ মাত্র। ঐ বুড়ো মানুষটাকে ফেলে আসলে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি যেমন আপনার দাদুকে ছাড়া থাকতে পারবেন না, ঠিক তেমনি আমার বাবার ক্ষেত্রেও। তাই শত প্রপোজাল আসলেও মুখের উপর না করে দিই। কিন্তু আপনার দাদু, আপনি, সাইফ ভাইয়া, নাবিলা আপু, আমি, আমার বাবা সবাই একই ক্যাটাগরির মানুষ। সবারই কিছু না কিছুর অভাব। তাই বাবাকে সরাসরি নাও বলি নাই, হ্যাও বলি নাই। কিন্তু বাবাকে ছাড়াটা পসিবল না।
নাইম চুপচাপ শুনে, হেসে বলল,
-বাড়িতে বিশাল জায়গা আছে। দাদুতো বললই আজকে। বাকিটা বলছি না। আমাদের যুগপৎ আলোচনা হওয়ার পর না হয় বলি।
নীলুফা হেসে ফেলল।
-হুম। আমাদের আলোচনা আগে শেষ হোক।
-তা, আমরা যদি ফোনেও কথা বলি, তাহলে হয়ত আলোচনাটা আরো বেশি করে করা যেত।
-তা যেত। আবারো বলছি, উচিত হবে না। (গাড়ি থেকে নেমে দরজাটা বন্ধ করে) কিন্তু অনুচিত কাজই তো সবসময় করে মানুষ। চেক ইউর পকেট, ইউ উইল গেট হোয়াট ইউ ওয়ান্ট!!!এখন যাই। আর হ্যা, ধন্যবাদ।
পকেট হাতড়ে দেখে একটা কার্ড। নীলুফার। অবাক হয়। পকেটে কখন ঢুকিয়ে দিল! চোখ তুলে দেখে, গেটের ভিতর চলে গেছে নীলুফা।
No comments