Header Ads

নয়ন বিশেষজ্ঞ



চেয়ারে হেলে দুলে বসা মেয়েটিকে ডাক্তার হিসেবে ভালই মানিয়েছে কিন্তু বউ হিসেবে কেমন হবে আরেকটু গবেষণা করা প্রয়োজন। নয়ন ওয়েটিং রুমে বসে কাচ ঘেরা চেম্বারের দিকে তাকিয়ে আছে। দরজা খুলে একজন করে রোগী যাচ্ছে আর সে উঁকিঝুঁকি দিয়ে মেয়েটিকে দেখে নিচ্ছে। মেয়েটির সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য গুণেগুণে পাঁচশ টাকা দিয়ে সিরিয়াল দিয়েছে। টাকা যাক আপত্তি নেই, মেয়ে দেখাটা জরুরী।
.
নয়নের মাথায় বিন্দুবিন্দু ঘাম। গলা শুকিয়ে চিড় ধরেছে। একটু পানি খেয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। এর মধ্যেই এসিস্ট্যান্ট ডাকা শুরু করে দেয়... রমিজ উদ্দিন কে? রোগীরা কেউ সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। এসিস্ট্যান্ট আবার বলে উঠে রমিজ উদ্দিন নেই? সিরিয়াল ২৫...?
নয়ন নড়েচড়ে উঠে বলে জ্বী আমি আমি, এসিস্ট্যান্ট কিছুটা অবাক চোখে তাকাল, এই প্রথম কোন রোগীকে দেখলো যে নিজের নাম কানে শুনেও সাড়া দেয় নি! অদ্ভুত ব্যাপার!
আসলে রমিজ উদ্দিন নামে সিরিয়ালটা তার বন্ধু দিয়েছে। নিজের পরিচয় লুকাতে মিথ্যা নামের আশ্রয়, তবে এই ছদ্মনামটা মনে রাখা বেশ কষ্টকর ছিল নয়নের কাছে।
-- আপনি রমিজ উদ্দিন?
-- জ্বী
(কিছুটা আড়চোখে তাকিয়ে)
-- ভেতরে যান
.
নয়ন লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। এটা যে লেডিস ডাক্তারের চেম্বার.. রুমের ডেকোরেশন তা নিঃশব্দে প্রকাশ করে দিচ্ছে। পর্দার রঙ থেকে শুরু করে পাপোশের রঙ সব কিছুই গোলাপি আর বেগুনীর সংমিশ্রণ। চোখ পরীক্ষা করার যন্ত্রদুটিও গোলাপি তোয়েলে দিয়ে ঢাকা!
এসব খুঁটিনাটি জিনিস লক্ষ করা নয়নের জন্মগত অভ্যাস। তাইতো বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টেও পিছিয়ে থাকেনি। ছদ্মবেশে পাত্রীকে নিয়ে গবেষণা করতে ছুটে এসেছে চেম্বারে। আজ রাতেই এই ডাক্তার মেয়ের বাসায় যাওয়ার কথা! নয়নের বাবার ভাবসাব ভাল মনে হচ্ছিল না। কিভাবে যেন পুরনো এই বন্ধুর মেয়ের খোজ পেয়েছে। মনে হয় আজ রাতেই কিছু একটা করে ফেলবে। তার মধ্যে ডাক্তার মেয়ে, নয়নদের বংশে কোনো ডাক্তার নেই। তার বাবাও ইঞ্জিনিয়ার সে নিজেও ইঞ্জিনিয়ার। তাই ফ্যামিলি থেকে ডাক্তারের প্রতি ঝোকটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে।
.
হুটহাট প্রপোজালে..হুটহ
াট দেখতে যাওয়ার প্ল্যান। পরিবার থেকে নয়নের উপর বিশেষ চাপ এসে যায়, বয়সতো বেড়ে যাচ্ছে আর কত দেরি? আজ হোক কাল হোক ফাঁসির মঞ্চে তাকে দাড়াতেই হবে.. তাই এবার আর অজুহাত না দিয়ে রাজি হয়ে যায়।
এদিকে মেয়ে কেমন না কেমন দেখার সুযোগটাও হয়নি। ছবিও হাতে নেই। পাত্রী দেখার মহলে সব মেয়েইতো আমেনা থেকে এভ্রিল হয়ে যায়! সবই আটা ময়দার কারসাজি। আর সেই মুহূর্তে যদি বিয়ে পড়িয়ে দেয় তখন! তাই আগেই দেখে নেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। ডাক্তার মেয়ে স্থানীয় চেম্বারেই পাওয়া যাবে, বন্ধুর দেয়া এই সহজ বুদ্ধিটা কাজে লাগায়।
.
যতটা সহজ মনে হচ্ছে নয়নের মত সরল শান্ত ছেলের কাছে কাজটা ততটাও সহজ না। মেয়ে যদি পছন্দ হয়ে যায়, কয়েক ঘন্টা পরেই যখন এই ছেলেকে নিজ বাসার ড্রয়িংরুমে দেখতে পাবে তখন মেয়ের রিয়েকশন কেমন হতে পারে? চিন্তার বিষয়! এমন নানান বাহারি রকম চিন্তা নিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসল।
.
মেয়ের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ, গোল গোল টানা চোখদুটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। নয়ন বসে বসে ভাবছে.. আই স্পেশালিষ্টের নিজের চোখও যে এতটা স্পেশাল হয় আগে তো জানা ছিল না! এত সুন্দর চোখ কি আগে থেকেই ছিল? নাকি চোখ নিয়ে গবেষণা করতে করতে সুন্দর হয়ে গিয়েছে! খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল। শ্যাম বর্ণের মেয়ে, ছিমছাম দেহগঠন। চোখদুটি অবয়বের মায়া আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
.
মেয়েটি প্রেসক্রিপশনে কলম ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করছে..
--- আপনার নাম বলুন...
ছদ্মনামটা মনে করতে ব্যর্থ হয়ে চট করে বলে দিল..
--- রফিক উদ্দিন
.
এর মধ্যেই মেয়েটির ফোন বেজে উঠে, পাশের রুম থেকে এসিস্ট্যান্ট কল দিয়েছে।
--- হ্যালো ম্যাডাম, যে রোগীটি এই মাত্র ঢুকেছে উনাকে মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না। উনার নাম ধরে ডাকার পড়েও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। সিরিয়াল মিলার পর বলে উঠলো আমিই রমিজ উদ্দিন!
(নিচুস্বরে কথোপকথন চলছে...)
--- কি নাম বলেছে??
--- রমিজ উদ্দিন
মেয়েটি চুপচাপ প্রেসক্রিপশনে চোখ বুলিয়ে দেখলো এই মাত্র তিনি রফিক উদ্দিন বলেছে। আসলেই বড় রকমের কোনো ঘাপলা আছে!
--- আচ্ছা, দেখছি, তুমি চেম্বারের দিকে একটু নজর রেখো।
--- ওকে ম্যাম।
.
মেয়েটার বড় বড় চোখদুটি কিঞ্চিৎ ছোট হয়ে যায়। ছেলের দিকে ডিটেকটিভ নজরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে..
--- কি চাই?
মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়..
--- চোখ!
--- কিহ?!
--- না মানে আমার চোখে সমস্যা
--- হুম, তাতো দেখতেই পাচ্ছি মোটা গ্লাসের চশমা পড়ে আছেন, এখন কি সমস্যা হচ্ছে সেটা খুলে বলুন
--- আসলে অনেক বড় সমস্যা, আমি চশমা খুললেই সবকিছু ঘোলা দেখি, আবার চশমা পড়লেই সব ক্লিয়ার!
--- ওমা তাই নাকি! কত দিন যাবত চশমা ব্যাবহার করছেন?
--- এইতো প্রায় দশ বছর
--- তো মিস্টার.. দশ বছর পর আজকে বুঝতে পারলেন যে চশমা খুললে আপনি ঘোলা দেখতে পান!!
--- এহেম এহেম, না মানে.. আসলে.. পাওয়ার আবার একটু পরীক্ষা করাটা প্রয়োজন।
ডাক্তার সানজানা ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বললো..
--- গ্লাসটি খুলে রেখে ঐ চেয়ারে গিয়ে বসুন।
.
রোগীর ভাব মর্জি মোটেও ভাল মনে হচ্ছে না। রোগী যে তাকে খুব ভালভাবে খেয়াল করে যাচ্ছে সেটা সে হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে। সানজানা চুপচাপ তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এদিকে মাথার ভেতর ঝড় তুলে ফেলেছে... কে হতে পারে.. কে হতে পারে...?। আজতো তাকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসার কথা, সেখানথেকে লোক পাঠিয়ে কোনো গোয়েন্দাগিরি করা হচ্ছে না তো?! কিছুক্ষণ ভাবতে ভাবতে মাথায় আসে.. নাকি... ইনিই সেই কাঙ্ক্ষিত পাত্র! তৎক্ষণাৎ পরপর দুবার হার্টবিট মিস হয়ে যায়!
এক্সকিউজ মি.. আমি একটু আসছি... বলেই দ্রুত বারান্দায় গিয়ে তার আম্মু কে কল দেয়। আজ যে বাবার বন্ধুর ছেলে দেখতে আসবে সে দেখতে কেমন কেমন একেরপর এক প্রশ্ন করে যায় তার আম্মুকে।
.
--- ছেলেকে আমরা অনেক আগেই দেখেছি, পূর্বের চেনাপরিচিত তাই ছবি লেনদেন হয়নি, বাসায় সামনাসামনিই দেখেনেব সবাই। কেন মা? এখন এসব জিজ্ঞেস করছিস কেন? কালকেই না তোকে বললাম ছেলেকে নিয়ে কোন প্রশ্ন আছে কিনা বল। তখনতো কিছুই বললি না। হাসিমুখে বলে দিলি তোমরা যেটা ভাল মনে করো। এখন আবার এত প্রশ্ন কেন? দেখ সানজানা, আমরা কিন্তু তাদের কথা দিয়ে ফেলেছি আজকেই তারা দেখতে আসবে, এখন কোনো তালবাহানা করবি না।
--- উফ আম্মু, তেমন কিছু না, যা যা প্রশ্ন করেছি উত্তর দাও তো, যতটুক দেখেছ ডিটেইলস বল আমাকে
একেরপর এক বর্ণনা মিলিয়ে নিশ্চিত হয়ে যায় এটাই সেই ছেলে। কল কেটে দিয়ে রাগে গড়গড় করতে থাকে। কত্ত বড় সাহস ছেলের! না জানিয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছে। দ্রুত মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে নিজের ফেইসটায় চোখ বুলায়। তাতে আরও মাথায় আগুন ধরে যায়। ক্লান্তিভরা জীর্ণশীর্ণ মুখ তেল চিটচিটে হয়ে আছে। এই বেহাল মুখ নিয়ে কেউ পাত্রের সম্মুখীন হয় নাকি! সেল্ফ সেটিসফিকশন বলতেওতো একটা ব্যাপার আছে। এগুলো কি ছেলেরা বুঝবে নাকি। যত্তসব খাটাস! মনে হচ্ছিল এক্ষুনি চেম্বার থেকে বেরিয়ে যেতে। তবে এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী সে না। উচিৎ শিক্ষা তাকে দিতেই হবে। নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে আবার রুমে প্রবেশ করলো।
.
ছেলেটা অবুঝ শিশুর মতন বসে আছে। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ডাক্তারো এবার মিষ্টি হাসি দিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালো।
--- স্যরি একটু লেইট হয়ে গেল
--- না না, সমস্যা নেই
--- আপনার চোখের পাওয়ারতো অনেক, - ৬.০!
--- জ্বী
--- আপনার আরেকটু পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। তাছাড়া আপনার চোখে কিছুটা ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। আপনাকে একটা ড্রপ দিয়ে টেস্ট করতে হবে। হাতে কি সময় হবে কিছুক্ষণ?
--- হ্যা, অবশ্যই! (মহাখুশি)
--- ঐপাশটায় গিয়ে বসুন।
.
কলিং বেলের শব্দে এসিস্ট্যান্ট ভেতরে প্রবেশ করে। সানজানা তাকে একটি আই ড্রপ হাতে ধরিয়ে বলে এটা উনাকে ৩ ফোটা করে দিয়ে দাও। এসিস্টেন্ট কিছু সময়ের জন্য থমকে গিয়ে বলে.. "কিন্তু ম্যাম এই ড্রপতো রোগীদের ১ ফোটা করে দেওয়া হয়!"
তোমাকে যেটা বলেছি সেটা করো, উনার এটা ৩ ফোটাই লাগবে! (মনেমনে বলে যায়... ৩০ ফোটা দিতে পারলে শান্তি পেতাম!)
.
এসিস্ট্যান্ট কথামত তার চোখে ড্রপ ফেলা শুরু করে। নয়ন দাঁত মুখ শক্ত করে বসে থাকে। ভয়ানক জ্বালাপোড়া! মনে হচ্ছে চোখে কেউ সালফিউরিক এসিড ঢেলে দিচ্ছে! তার মোচড়ামুচড়ি দেখে ডাক্তার সানজানা বলে উঠেন একটু লাগবেই, ঠিক হয়ে যাবে, আপনি কিন্তু ভুলেও চোখ খুলবেন না। খুললে আরো বেশি জ্বলবে। নয়ন লক্ষ্মী ছেলের মত মাথা নাড়ে, চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে।
.
সানজানা অন্য রোগী দেখার পাশাপাশি একটু পরপর ছেলেকে তাকিয়ে দেখছে। পাত্র মশাই আর পাত্রীকে কি দেখবে, উল্টো.. পাত্রী এবার পাত্র দেখায় ব্যস্ত!
বিশেষ এই রোগী চেম্বারে আসায় সানজানা আজ আর রোগী দেখবে না। চেয়ার থেকে উঠে নয়নের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
--- এক্সকিউজ মি, আপনার কি জ্বালাপোড়া কমেছে?
--- জ্বী কমেছে, আমি কি এবার তাকাতে পারি?
--- হুম, মাথা উঁচু করে বড় বড় করে তাকান
ছেলেটা চোখ খুলে তাকাতেই আবারো সেই ড্রপ দুফোটা করে ফেলা হয়!
আওও...হ...! শব্দে আর্তনাদ বেড়িয়ে আসে
--- ওমা! এত বড় ছেলে সামান্য একটু ড্রপেই এই অবস্থা!
--- না না আমি ঠিক আছি। (চুপচাপ আবার চোখ বন্ধ করে থাকে)
.
সানজানা মুখে হাত চেপে কিটকিট করে হাসছে।
এদিক সেদিক ঘুরেঘুরে ছেলেটাকে নিখুঁত ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সানজানার রাগ ততক্ষণে অনেকটাই কমে গিয়েছে। নাহ, যতটা খারাপ ভেবেছিল ছেলেটা ততটাও খারাপ নাহ! ভালই আছে,, আরেকটু ভেবে দেখা যায় !!

No comments

Powered by Blogger.