Header Ads

মেস



মেসে মেয়ে আনা যাবেনা। তবুও মেসের নিয়মকানুনকে তোয়াক্কা না করে সেলিম ভাই মেয়ে নিয়ে আসছেন।
আমরা ভয়ে অস্থির হয়ে আছি। মেস মালিক বলে দিয়েছেন মেসে ওঠার সময়েই।
১। মেসে আড্ডাবাজি নিষেধ।
২। ধুমপান করা যাবেনা।
৩। এবং এবং এবং কোন মেয়ে আনা যাবেনা। কেউ আনলে তাকে মেস থেকে বিনা নোটিশে বের করে দেয়া হবে। কান ধরে পনেরবার উঠবস করানো হবে।
'এবং' লেখা তিনবার।
আমাদের কাছে এটা রীতিমত স্বৈরশাসকের মেস । যেহেতু ভাল মেস পাওয়া যায়না তাই সকল নিয়ম মানবো এই শর্তেই মেসে উঠেছিলাম সবাই।
কিন্তু সেলিম ভাই এ কি করলেন?
সেলিম ভাই ধপাস করে তার রুমের দরজা আটকিয়ে দিলেন। আমরা সবাই তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কি হচ্ছে ঘটনা বোঝার জন্য।
কেউ জানালার ফুটো দিয়ে দেখার চেস্টা করছে কি করে সেলিম ভাই মেয়েটার সাথে তা দেখেই ছাড়বে।
এদিকে আমাদের পাশের রুমের রাশিম মেস মালিকের চামচার মত। সে গেল মেস মালিককে ডেকে আনতে।
এর আগেও সে মেস মালিকের কাছ থেকে পুরষ্কার পেয়েছে এসব অসামাজিক কাজ ধরিয়ে দেয়ার জন্য।
খবর পেয়ে মালিক এক দৌড়ে হাজীর। উনি রাগে ফুঁসছেন।
কিছুক্ষণ পর পর হেঁচকি তুলছেন। রাগলে ঘন ঘন হেঁচকি তুলেন। রাশিম তার পেছনে জগ ভর্তি পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে।
আমরা ভয় পেলেও মনে মনে খুব উত্তজিত। মানুষ এমনই। আশে পাশে খারাপ ঘটনা ঘটলে সমধানের চেয়ে কি হচ্ছে, হতে যাচ্ছে তা দেখতেই বেশী পছন্দ করি।
আমাদের মেসে রবিউল ভাই পরহেজগার মানুষ। কিছুক্ষণ পর পর আমাদের সামনে এসে ‘নাউজুবিল্লাহ , আস্তাগফিরুল্লাহ ’ বলছেন আর মেস মালিককে উত্তেজিত করে দিচ্ছেন।
‘বুঝলেন আংকেল এসব ছেলেপেলের জন্যই আজকাল শহরে ভাল মেস পাওয়া যায়না। আরে বাবা তোরা বাইরে আসছিস পড়তে। মেসে কেন মেয়ে আনবি”।
মেসের সবচেয়ে ছোট রুমে থাকে মামুন। তার রুমটা যেমন ছোট তার শরীরও তেমন ছোট। কথায় বলে, খাটো মানুষের বুদ্ধি বেশী।
রবিউল ভাই যখন মালিকের পাশে দাঁড়িয়ে নানা নীতিবাক্য শোনাচ্ছেন তখন মামুন বলে বসলো-
‘রবিউল ভাই কাল সিনেমা কেমন দেখলেন? আপনিতো আবার সন্ধ্যা হলেও সিনেমা হলে দৌড় দেন- তা ভাবিকেও নিছিলেন নাকি?’
রবিউল ভাই ক্ষেপে গেলেন।
‘কি বলছো যা তা । আস্তাগফিরুল্লাহ, তোমার উপর গজব পড়ুক’।
আমরা রবিউল ভাইয়ের কথায় তেমন কর্ণপাত করলাম না।
কারণ তিনি এমনই।
সন্ধ্যা হলেই লুঙ্গী পড়ে ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে সিনেমা হলে যান। লুঙ্গী পড়লে কেউ সন্দেহ করেনা। আমরাও ভাবি তিনি হয়তো আশে পাশেই একটু হাঁটাহাঁটি করেবেন।
কিন্তু রবিউল ভাই মেসে ফিরেন ঠিক তখন যখন শো শেষ হয়। মেসের পাশেই সিনেমা হল।
যাক সে কথা। মেস মালিক ক্ষেপে গিয়ে সেলিম ভাইয়ের দরজায় ধাক্কা দেয়া শুরু করেন।
‘এই লুচ্চা ঘর থেকে বের হ- মাগিবাজি আমার মেসে চলবেনা’
সেলিম ভাই দরজা খুললেন। আমরা ব্যাপক উত্তেজিত হয়ে মালিকের পেছনে পেছনে সেলিম ভাইয়ের ঘরে ঢুকি।
সেলিম ভাই আমাদের সব উত্তেজনা মাটি করে দিলেন। মেস মালিকের চোখ ছানাবড়া। আমরা ধরেই নিয়েছি কিছু একটা হতে যাচ্ছে।
দিনে দুপুরে মেসে মেয়ে নিয়ে হাজির! এ কেমন কথা !
সেলিম ভাই হাসি মুখে মালিককে বললেন- "আংকেল শরীরটা ভালো ?"
মেসমালিক উত্তর না দিয়ে হনহন করে মেস থেকে চলে গেলেন।
সেলিম ভাই কোন মেয়ে আনেননি। উনার বন্ধু রানাকে বোরকা পড়িয়ে নিয়ে আসছেন। বিকেলে তাদের মঞ্চ নাটক আছে ক্যাম্পাসে। সেটার একটা প্রস্তুতি হিসেবেই এই কাজ।
বোরকা খুলে তার বন্ধু বসে আছেন মেঝেতে। পড়নে হাফ প্যান্ট।
আহা সেই মেসের কথা খুব মনে পড়ে। তার চেয়ে বেশী মনে পড়ে রাজ্জাক ভাইকে।
সারাদিন রাজ্জাক ভাইকে দেখতাম মন খারাপ করে থাকতে। মেসে তার নির্দিষ্ট কোন রুম ছিলোনা।
আমরা সবাই একরকম দয়া দেখিয়েই তাকে আমাদের মেসে রাখতাম। তাকে কোন ভাড়া দিতে হতোনা।
বিনিময়ে তিনি মেসের বাজার সদাই করে দিতেন।
বছর জুড়ে মেসে সবার মিলের হিসাব রাখতেন।
রাজ্জাক ভাই ঈদের সময়ও মেসে থাকতেন। বাড়ী যেতেন না।
তিনি খুব ট্যালেন্ট। আমরা তার কাছ থেকে ইংরেজি শিখিয়ে নিতাম। প্রাক্টিক্যাল খাতা লিখে নিতাম।
যদিও তার মাধ্যমিকে রেজাল্ট একটু খারাপ। তবুও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছেন রাত জেগে পড়ার কারণে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নিয়মিত ক্লাস করতে পারতেন না।
মেসে নিজের টাকায় কোন মিল খেতেন না। খাবেন কি করে। টাকা থাকলেতো!
মেসের রান্নার খালা তাকে খুব সমিহ করতেন। নিজের খাবারও রাজ্জাক ভাইকে দিতেন মাঝে মাঝে। গরিব গরিবের কষ্ট বেশী বোঝে।
রাজ্জাক ভাইয়ের বাবা মা খুব গরীব। এমন গরীব আমি দেখিনি কোনদিন।
আমরা যে রেজোর দিয়ে শেইভ করতাম সেটা দিয়ে তিনিও শেইভ হতেন।
এধরণের কষ্টের গল্প বই বইপুস্তকে পড়েছি। কিন্তু রাজ্জাক ভাই সব গল্পকেও হার মানান।
এই রাজ্জাক ভাই পায়ে হেঁটে ৬ কিলোমিটার দূরে ক্যাম্পাসে যেতেন। তার বিষয় সামাজিক বিজ্ঞান।
আমি চারটা বছরে দুটার বেশী শার্ট রাজ্জাক ভাইকে পড়তে দেখিনি।
খুব কষ্ট হতো রাজ্জাক ভাইয়ের জন্য।
টিউশানি করাতেও পারতেন না তেমন। কারণ বেশিরভাগ সময় তার মেসের বাজার সদাই করেই সময় চলে যেত।
তবে হ্যাঁ তিনি দুইটা টিউশানি করাতেন। রাতে রাতে । সেটার টাকা বাড়ীতে পাঠাতেন। ছোট বোনের নামে। বাবার নামে।
পর খবর এই যে- রাজ্জাক ভাই নিয়মিত ক্লাস না করার কারণে খুব একটা ভালো রেজাল্ট করতে পারেননি অনার্সে।
তবে আনন্দের খবর – তিনি বর্তমানে ঢাকার একটী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উঁচু বেতনে চাকরী করেন।
সময় পেলে রাস্তায় পথশিশুদের সাথে আড্ডা দেন... বাবা মা ছোট বোনকে নিজের বাসাতেই রেখেছেন।
আর এই রাজ্জাক ভাইকে মেসে থাকাকালীন দেখেছিলাম-
চারটা বছরে মাত্র একবার তার বাবা তাকে দু'টা সাদা সেন্ডু গেঞ্জি পাঠিয়েছিলেন।
সাথে একটা চিঠি-
"বাবা কিছু দিতে পারলাম না। আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করি আল্লাহ্‌ তোমাকে দেখে রাখেন যেন। আমাদের নিয়ে চিন্তা করোনা।
টাকা না পাঠিয়ে নিজের পড়াশোনার কাজে খরচ কর..."
হ্যাঁ মনের ইচ্ছে শক্তি, শ্রম আর সাহসেই মানুষ সামনে এগোয়। রাজ্জাক ভাই সেই দলেরই একজন। জয় এমন সংগ্রামেই আসে) ৷

সোহানুর রেজা

No comments

Powered by Blogger.