আমার বোরিং স্বামী
আমার স্বামী আমার থেকে গুনে গুনে ১২ বছরের বড়, একজন বোরিং আর আনরোমান্টিক মানুষের এর মধ্যে যে যে গুন থাকা দরকার তার সবই আছে তার মধে। আমি সেলিনা গোমেজ আর এডাম লেভিইন এর ফ্যান তিনি রাজ্জাক আর সাবানার। আমি দেখবো স্টার মুভিজ সে দেখবে এটিএন নিউজ। বিয়ের এই একবছর পরও তার সাথে বসে আমার কোনো রোমান্টিক মুভি দেখা হয়নি কারন বাংলা মুভি আমি দেখিনা আর হিন্দি তিনি বোঝেননা। তাকে বার বার বলি হাল্কা চাপ দাড়ি রাখতে তিনি প্রতিবার সেল্যুন এ যেয়ে ছুলা মুরগি হয়ে আসবেন, দাড়ি তে নাকি তার চুলকায়.
আমার খুব ইচ্ছা করতো দুজন মিলে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো কিন্তু তার নাকি ঠান্ডা লাগে জোসনা হলে যদি বলি চলো ছাদে যেয়ে একটু জোসনা দেখে আসি সে বলে জানালা দিয়ে দেখো এতো রাতে ছাদে ভুত আছে ঠ্যাং ধরে আকাশে নিয়ে নিচে ফেলে দেবে, কখনো কক্সবাজার যাইনি আমি যদি বলি এবার অফিস এর চাপ কমলে ছুটি নিয়ে চলোনা একটু কক্সবাজার ঘুরে আসি , সে বলে পুকুরে যাও এক ডুব দিয়ে আসো। জিনিষ তো একই ওখানেও পানি এখানেও পানি। শাড়ি পরলে আমাকে সুন্দর লাগে, অন্তত সবায় তাই বলে অথচ বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত সে আমার প্রসংসা করা তো দুরে থাক শাড়ি পরলে আমার দিক ২ বার ফিরেও তাকায় না।
এর মধ্যে এক সকালে জানতে পারলাম আমাদের মধ্যে ৩য়জন আসছে। আমি ভেবেছিলাম সিনেমার মত খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরবে বা কিছু একটা তো করবেই কিন্তু ও কোনো রিয়াকশন ই দেখালো না। খুশি হয়েছে না রাগ হয়েছে না অন্য কিছু কিছুই বুঝলাম না। মেজাজ তো চরম খারাপ। মনে মনে সারাদিন নিজের কপাল কে গালি দিছি আল্লাহ্ এই ছিলো আমার কপালে দুনিয়াই কি আর কোনো রোমান্টিক ছেলে বেচে ছিলো না যে তুমি এই বুড়োর সাথে আমার বিয়ে দিলে। রাতে দেখলাম এক বস্তা ভরে ফলমূল নিয়ে এসেছে আমিও দেখে মুখ ঝামটি দিলাম হুহ যাও তুমি ভাগো।
এভাবেই দিন যাচ্ছিলো আমার বার বার মনে হতো বাচ্চা হওয়ার সময় হয়তো আমি মরে যাবো। মাঝে মাঝে রাতে ওর বুকে মাথা দিয়ে বলতাম আচ্ছা বাবু হওয়ার সময় যদি আমি মরে যাই তাইলে কি তুমি আরেকটা বিয়ে করবে? মনে মনে ভাবতাম ও হয়তো গল্পের নায়কদের মতো আমার কপালে চুমু খেয়ে বলবে " না পাগলি " কিন্তু দেখা যেতো তার কোনো রিয়াকশনই নেই। চুপ করে থাকতো যখন বুঝতাম চুপ করে থেকে ও মৌন সম্মতি দিচ্ছে তখন লাফ মেরে উঠে বলতাম শোনো শালা আমি মরার পর যদি আরেকটা বিয়ে করেছো তো ভুত হয়ে এসে তোমার ঘাড় মটকে দেবো নয়তো রাতে যখন অফিস করে বাসায় আসবা তখন ঠ্যাং ধরে নিয়ে আকাশে নিয়ে যাবো।
দেখতে দেখতে ৫ মাস হয়ে গেলো একদিন বাসায় কেও নেই আমি বাথরুম এ গিয়েছি হঠাৎ পা পিছলে কমডের উপর উপুর হয়ে পরে গেছি পেটে এক জোরে বারি খেলাম। কোনোমতে বাথরুম থেকে বের হয়েই বিছানায় পরে গেলাম ততক্ষণ এ ব্লিডিং শুরু হয়ে গেছে কিন্তু আমার হুস নেই আমি যে ওকে ফোন দিবো তাও পারছিনা চোখে সব ঝাপসা দেখছি শাশুড়ি ছিলো নিচতলায় ডাকতে যাচ্ছি কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছেনা। তারপর কি হলো আর মনেনেই ছাড়া ছাড়া হুস এসেছিলো দেখলাম শাশুড়ি দৌড়ে আমার কাছে আসলো বললো এতো রক্ত আসলো কোথা থেকে আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিলো না। এরপর বাথরুম এ যেয়ে টিস্যু পেপার এর উপর একদলা রক্ত নিয়ে আসলো ঝাপসা ঝাপসা চোখে দেখলাম লম্বা লম্বা হাত পা একদম ওর মতো চোখের ,মনি ,ঠোট ,কান ,মার্বেল এর চেয়েও ছোট্ট একটা নুনু। আমার ছেলেটা তখনও কাপছিলো হয়তো ভয় পাচ্ছিলো তারপর আস্তে আস্তে ওর কাপা থেমে গেলো আর আমি আবার বেহুঁশ হয়ে যাই। আমার হুশ আসে ৪ দিন পর খুলনা ২৫০বেড এর আইসিইউ তে। তখন আমার হাত পা পেঠ সব বেড এর সাথে দড়ি দিয়ে বাধা। একটা নার্স এসে আমার সাথে একটু কথা বলে তারপর দড়ি খুলে দেই। সারাদিন অপেক্ষা করি কিন্তু কেও আমাকে দেখতে আসেনা। মনে মনে ভাবি তাইলে সবায় কি আমার উপর রাগ করলো একটা মানুষও আসলো না হাসপাতালে আমাকে দেখতা। দুঃখে কস্টে কান্না চলে আসে। তারপর দিনও কেটে যায় তাও কেও আসেনা। ডিউটি নার্স চেইঞ্জ হয়ে একটা বয়স্ক মহিলা আসে, এসে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে মা" আপনি ভালো আছেন? " আমি মাথা নারি
উনি বললো "আপনাকে নিয়ে তো সবায় খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো ডাক্তার রা তো ভরতিই করতে চাইনি বলছিলো আপনি বড়জোর ২ ঘন্টার মতো বাঁচতে পারেন তার বেশিনা"। আমি বললাম" কেনো"? উনি বললো আমার ডায়াবেটিস আর প্রেসার দুইটাই অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিলো শেষে ওর কাছ থেকে বন্ড সাইন নিয়ে তারপর আমাকে আইসিইউ তে নেওয়া হয়। আমাকে বললো লম্বা মতো ওই ছেলেটা আমার কি হয় আমি বুঝলাম ওর কথা বলছে আমি বললাম আমার স্বামী উনি বললো আপনার স্বামী টা আপনার জন্য অনেক কষ্ট করেছে আজ ৪ দিন রাতদিন উনি আইসিইউর বারান্দায় আছে একবারের জন্যেও বাসায় যায়নি আমরা তো সবায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম কিন্তু উনি একবারের জন্য হাল ছাড়েননি। যখন আপনাকে এনেছিলো উনি খুব কান্নাকাটি করছিলো আমরা তো সবায় উনার কান্না দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি একপাশে মুখ ফিরিয়ে বললাম তা ও তো আমাকে একবারের জন্যেও দেখতে এলো না। তখন সেই নার্স একবার বাইরে গেলো তারপর ভিতরে এসে আমার পায়ের ধারের জানালা টার পর্দা সড়িয়ে দিলো। দেখলাম বাইরে ও উস্কোখুস্কো চুলে জানালার সামনে দাড়িয়ে হাত নাড়াচ্ছে। নার্স বললো আইসিইউ তে বাইরের কেও আসা নিষেধ এভাবে রুগী দেখানোও নিষেধ কিন্তু আপনার স্বামীর অনুরধে আমার খুব মায়া হলো। আপনার তো হুশ ছিলো না এই চারদিন আমি আসার পর এভাবে জানালা দিয়ে উনাকে আপনাকে দেখাতাম। ওর চোখের দিকে তাকালাম ওর চোখে কি ছিলো জানিনা হয়তো একটু পানি ছিলো হয়তো একটু ক্লান্তি আর হয়তো একটু কষ্ট, তখন বুঝলাম বাস্তবের নায়কে রা কখনো গল্প বা সিনেমার নায়কদের মতো রোমান্টিক হয়না বাস্তবের নায়কদের ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা থাকে ভিন্ন বাস্তবের নায়কেরা খুব বোরিং হয়
আফরিনা পারভীন এশা
No comments