Header Ads

বালক

বালকটিকে প্রথম খেয়াল করলাম
ক্লাসে। একমনে পেন্সিল চিবুচ্ছিল।
ভঙ্গীমা দেখে মনে হলো, পেন্সিল
চিবুনোর উপর বুঝি নির্ভর করছে ওর
জীবণ-মরণ! বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে
গেলো। এই ছাগল কিনা আমার
বায়োলোজি প্র্যাকটিকেলের
পার্টনার! একটা সেরা অকর্মা। ছাত্র
ভাল, হাতের লেখা আর বিচার-বুদ্ধি ও
মোটামুটি মানের। তাই তাকে
পার্টনার করার ব্যাপারে আগ্রহী
ছিলাম। আর এখন ইচ্ছে করছে তার
চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বানাই। কিংবা
হাড্ডি দিয়ে ঝুনঝুনি! তাতে যদি
কিছুটা রাগ কমে আমার। চোখ বড় বড়
শ্বাস নিলাম। রাগ নিয়ণ্ত্রন করতে
চাইছি আসলে। চোখ খুলে দেখলাম, সে
এখনও নীরিহ পেন্সিলের রস আস্বাদনে
ব্যস্ত! আর পারলামনা নিজেকে
সামলাতে। এগিয়ে গেলাম........
"তুমি কি খুব ক্ষুধার্ত?"
বালক হকচকিয়ে গেলো।সেভাবেই
জানতে চাইল,"মানে?"
"সকাল থেকে কিছু খাওনি, না?" বালক
তাকিয়ে আছে। অবাক চোখে। আমার
রাগ আরো বেড়ে গেল।
"এই ছেলে তোমাকে বলছি! এভাবে
পেন্সিল চিবুচ্ছ কেনো? ক্ষিধে
পেলে ক্যান্টিনে যাও!"
"না মানে..... আমি যখন খুব টেনশনে
থাকি........."
"বিশিষ্ট চিন্তাবিদ সেজেছেন উনি।
এক্সপেরিমেন্টটার কিছু তো করতে
পারলেননা! চিন্তাবিদ হয়েছেন!
নির্ঘাত প্র্যাকটিলে ধরা খাব এবার!!"
"ব্যাটা অসভ্য!"
বলেই সব ফেলে রাগে গজগজ করতে
করতে ল্যাব ছাড়লাম।বালক তখনও
পেন্সিল হাতে বসে!
(২)
এরপর খেয়াল করলাম পার্কে। এখনও স্পষ্ট
মনে আছে আমার। তাহি আমার বেস্ট
ফ্রেন্ড ছিল তখন। ঝগড়াটে হিসেবে
প্রচন্ড সুনাম থাকার দরুণ আমার কপালে
ফ্রেন্ড জুটতোনা খুব একটা। যাই
হোক,তাহির সাথে ঝগড়া করেছিলাম
সেদিন। আর পার্কের বেঞ্চে বসে
হাপুস নয়নে চেঁচিয়ে কাঁদছিলাম।
আমি নিঃশব্দে কাঁদতে
পারিনা,কখনোই না! হঠা্ত কারো
ছায়া পড়ল আমার উপর। তাকিয়ে দেখি
তিনি। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ বালক!
অবাক হলাম!!! কোথথেকে এলো সে?
মাঝে তিন বছর দেখা হয়নি ওর সাথে।
কিংবা হয়েছে,খেয়াল করিনি।
কারণ,আমি ভীষণ দাম্ভিক ছিলাম।
যেঁচে কারো সাথে কথা বলতামনা।
খোঁজ রাখা তো অনেক দূরের ব্যাপার!
কিন্তু ফটোগ্রাফিক মেমোরির
অধিকারী ছিলাম বলে,তাকে দেখা
মাত্রই চিনলাম।
"কান্না শেষ? নাকি আরো কাঁদবা?"
কিছু না বলে রাগী চোখে তাকিয়ে
রইলাম। সে আমার পাশে বসে এক
প্যাকেট টিস্যু এগিয়ে দিলো। "বোঝা
গেছে কান্না শেষ। নাও চোখ মুছে
ফেলো,কাঁদলে তোমার চেহারার
জংলী বিল্লী ভাবটা চলে যায়!"
আমি তবু চুপ। ব্যাটা নিশ্চিত শোধ
নিচ্ছে! কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিনা।
আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে ভরাট
গলায় বলে উঠল..........
"কিরে,কাঁদবি নাকি?
শুকনো মুখে বসে আছিস!
চোখগুলো ভেজা ভেজা..........
ঝুম বৃষ্টি নামবে নাকি?
ঐ স্বপ্ন আঁকা চোখে!
তুই দেখি একদম বোকা!!!
রাগ না ভেঙ্গে ও রাগাতে আসিস।
ফিনিক্স হয়ে উড়বি নাকি?
জ্বলে,পুড়ে,ভস্ম হয়ে,
উড়বি নীলাদ্র আকাশ হয়ে!
দু'চোখে দেখি মেঘ জমে!!!
ঝুম বৃষ্টি নামবে নাকি?
যখন তখন লুকিয়ে বসে,
হিঁচকি তুলে কাঁদবি নাকি?"
আবৃত্তি শেষ করা মাত্রই তিনি তার
উদাস ভঙ্গী গ্রহণ করলেন। আকাশের
দিকে তাকিয়ে এক হাত দিয়ে
কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি
নির্মমভাবে চুলকাতে লাগলেন। ঘ্যাস
ঘ্যাস শব্দ করে! বিরক্তিকর দৃশ্য,তাতে
সন্দেহ নেই। ইচ্ছে করছিল,এক ঘা বসিয়ে
দিই মাথায়। তাতো করলাম ই না,বরং
তার কবিতার কথা ভেবেই বোধহয়
ধপাস। চোখ খোলা রেখেই হতচ্ছাড়া
বালকের প্রেমে পড়ে গেলাম! আর
পড়েই ডুবে গেলাম!!! কানে আশপাশের
কোন শব্দ আসছিল না,শুধুমাত্র ঐ ঘ্যাস
ঘ্যাস শব্দ ছাড়া! কী ছিলো তাতে কে
জানে!
(৩)
এরপর খেয়াল করলাম প্রায় দু'বছর পর।
আমি আর বালক পাশাপাশি বসে।
সাথে আমাদের কয়েকজন বন্ধু। সবার
এমনকি টেবিলের অপর পাশের
আইনজ্ঞের ও ভ্রু কুঁচকে আছে
বিরক্তিতে। কিন্তু তিনি নির্বিকার!
চুপচাপ হাতের কলমের নিব চিবুচ্ছেন।
চেহারায় কিছুটা বিভ্রান্তি ও ভয়ের
ছাপ। যেন তার সামনে রাখা
কাগজগুলো বিবাহের অঙ্গীকারনামা
নয়। বরং তার এ যাবতকালের পাপকর্মের
আমলনামা!
(৪)
তারপর ছোটখাটো কত ঘটনা! আমাদের
ছোট্ট সংসার। উদাসী বালক আর
ঝগড়াটে বালিকার জীবণ। কিংবা
নীরিহ চিন্তাবিদ আর জংলী
বিল্লীর একগাদা খুনসুটি। দুর্বল স্মৃতি
হাতড়ে বেড়াই। ওর সাথে শেষ কখন
দেখা হয়েছিল? মানে শেষ কবে
খেয়াল করেছিলাম বালকটা
কে! ............হু মনে পড়েছে!
ওকে শেষবার খেয়াল করেছিলাম
এয়ারপোর্টে। ও কেমন যেন বিধ্বস্ত
হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি মায়ের
কাছে চলে যাচ্ছিলাম,নিজের ইগো
বজায় রাখার জন্যই। বালক কিচ্ছু
বলেনি। বাধামূলক একটা কথা ও না!
একমনে নখ খুঁটছিল আমি যখন রাগী গলায়
মনে করিয়ে দিলাম আমার চলে
যাওয়াটা,তখন শুধু মুখ তুলে একটু
হেসে,হাতে কাগজের ছোট একটা
প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। না খুলে ও
বেশ বুঝতে পারছিলাম,তাতে একমুঠো
কৃষ্ণচূড়া!
"বাণীর খেয়াল রেখো,সাথে জংলী
বিল্লীটার ও!"
ওর কথা শুনে,নিজের অজান্তেই
পেটের স্ফীত হয়ে ওঠা অংশে হাত
চলে গেলো আমার! ওখানে নতুন একটা
অস্তিত্ব সগর্বে নিজের উপস্থিতি
জানান দিচ্ছে। চোখজোড়া জলে
ভরে গেলো। অপেক্ষা করলাম,ও হয়ত ওর
ভুল বুঝতে পারবে। আমাকে ছুঁয়ে কথা
দেবে,আর ধূমপান করবেনা! আমি
থামবো তাহলে। কিন্তু না........... সে
কখনো কারো সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ
করতে চায়নি।
(৫)
বিরাট বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটা। রক্তলাল
কৃষ্ণচূড়া চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে রোদ
গায়ে মেখে। আর গাছটার ছায়ায় সে।
চিন্তাবিদ বালক! শুয়ে একমনে নখ
খুঁটছে,আর আকাশ দেখছে। মুখভর্তি
খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। কখন যে ঘ্যাস
ঘ্যাস শুরু হয়ে যায় আবার,এ ভয়ে
ডাকতে গলাম। বাধা পেলাম বাণীর
রিনরিনে কন্ঠস্বরে। "আব্বুই
কোথায়,আম্মুনি? তুমি না
বলেছিলে,এখানে আছে?"
"ঐতো ওখানেই তোর আব্বুই। শুয়ে একমনে
তোর কথা ভাবছে। কখন তুই ডাকবি!"
বলে হাতের ইশারায় সামনের দিকে
নির্দেশ করলাম।যেখানে বড়সড় একখন্ড
শ্বেতফলক! ও সবসময় বলতো,"বালিকা,অত
আবেগ ভালো নয়। যে আবেগের কাছে
মানুষ প্রতিনিয়ত পরাজিত হয়!" চুপচাপ
মেনে নিতাম তখন! কিন্তু........ "এই
বালক.....এই....তুই যে আবেগ দেখিয়ে
চলে গেলি? তা বুঝি কিছু নয়???
ওখানে একমনে ভাবতে পারিস,তাই
না? .... ইচ্ছেমত পেন্সিল কিংবা কলম
ভাংতে পারবি ভাবনার ছলে। ধোঁয়া
গিলতে পারবি গাদা গাদা!
ধমকাবার জন্য আমিতো নেই!"
অস্পষ্ট হয়ে আসা দৃষ্টি মেলে ফলকটা
পড়ার চেষ্টা করলাম...... "সায়েম রহমান
শুভ্র" ঠিক এই নামটাই ছিল বিয়ের
কাবিননামায়! ফলকটায় হাত বুলালাম।
"বালক,কী হত আরেকটু অপেক্ষা করলে?
কী হত,শেষ একবার আবেগী বালিকার
রাগ ভাঙ্গালে?" বাণী এগিয়ে এসে
চোখ মুছে দিলো আমার। "আম্মুনি,তুমি
শব্দ না করে কাঁদতে পারো?"
মেয়েটাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম
সেখানে,সেই শ্বেতফলকের পাশেই।
আমাদের ছোট্ট সংসার পূর্ণতা পেলো
যেন এতদিনে. . . . . . . .
(৬)
পরীর মত একটি ছোট্ট মেয়েকে কোলে
নিয়ে এক তরুণী বসে আছে। পাশে
কৃষ্ণচূড়ার স্তূপের মাঝ থেকে উঁকি
দেয়া একটি এপিটাফ! বাতাসে ভর
করে ভেসে আসছে পরিচিত কারো
গন্ধ। যেনো হারিয়ে যাওয়া উদাসী
বালকের একটি অস্তিত্ব ফিরে
এসেছে,প্রিয় মানুষগুলোর খোঁজে,তা
টের পেয়েই হয়ত তরুণী মৃদুস্বরে গাইতে
লাগল,
" যুদ্ধ শেষে আজ ঘরে ফিরে
দেখি তুমি নেই যে পাশে
ভেবেছিলাম তুমি থাকবে দাড়িয়ে
কৃষ্ণচূঁড়া ফুল হাতে
তবে কি যুদ্ধে গেলাম তোমায়
হারাতে?
এপিটাফের লেখাগুলো পড়ি ঝাপসা
চোখে
আমি তো দিয়েছিলাম তোমায়
কৃষ্ণচূঁড়া ফুল
তুমি তো গেয়েছিলে সেই নতুন
গানের সুর
আমি তো দিয়েছিলাম তোমায়
কৃষ্ণচূঁড়া ফুল
তবে কেন আমি গেলাম চলে তোমায়
ফেলে বহুদূর
বহুদূর...........বহুদূর............বহুদূর

No comments

Powered by Blogger.