Header Ads

শেষ বেলার শেষ বেলায় এসে


সর্বনাশ ! সন্ধ্যা হয়ে গেছে ৷ এখান থেকে এই সময়ে বাড়ী ফেরা তো মুশকিল ৷মেঘ ডাকছে, যে কোন সময় বৃষ্টি হবে ৷ এখন কি করি !
ব্যাগে বইটা ঢুকিয়ে নিয়ে ঝট করে উঠে দাড়াবো ঠিক এই সময় কেউ একজন পেছন থেকে কাশি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল ৷ পিছনে ফিরতেই বলল --
--বৃষ্টি হবে বোধয় ম্যাডাম ৷ছাতা আছে সাথে ?
--না নেই ৷ আপনার তাতে কি? (ঘাড়ত্যাড়া পাল্টা প্রশ্ন)
--না মানে , আমি এখানে প্রতিদিন ই আসি আর আপনাকে দেখছি অনেকদিন ধরেই ৷ প্রতিদিন তো তাড়াতাড়ি যান, আজ এখনো.....!
--আপনি রোজ আমাকে ফলো করেন নাকি ?
--ঠিক তা না ৷ আপনিও আসেন আমিও আসি ,তাই দেখা হয় ৷
--ও আচ্ছা ৷ভাল ৷ যেতে হবে আমাকে ৷ কথা বলার যথেষ্ঠ সময় নেই এখন ৷ দুঃখিত ৷ চলি ৷
--কোথায় যাবেন ?
--বাসায়, আবার কোথায় !
--বাসা কোথায় ?
--কাছেই ৷ (উহুম, লোকটাকে বলা যাবে না আমার বাসা কোথায় ৷ মনে আছে এভাবে সবকিছু বলে বোকামি করে বিপদে পরেছিলাম একদিন ৷)
-- এগিয়ে দেব?
--না
আর কোন কথা না বলে সোজা এগুতে থাকলাম, এক ফোঁটা বৃষ্টির জল ঠিক নাকে এসে পরল ৷ এবার জোড়েই পরছে বেশ , হঠাৎ যেন আমার চারপাশেই বৃষ্টি, কিন্তু আমি ভিজছি না ৷ মাথার উপর কেউ একজন ছাতা ধরেছে ৷
--আপনি আবার !
--এজন্যই বলে কারো সেচ্ছায় উপকার করতে নেই ৷
যদিও একটু একটু ভয় লাগছে ৷ তবে এই পরিস্থিতিতে একটু সাহায্যের দরকার আমার অবশ্য ৷আমার পাখি দম্পতির খাচাটা মা ঢেকে রেখেছে কিনা কে জানে !ওদের জন্যও চিন্তা হচ্ছে ৷ এলবার্ট-ভিক্টোরিয়া নাম দিয়েছি ওদের ৷ আহা, মানুষের মধ্যেও এই প্রেম আর দেখি না ৷ যাইহোক, তিনি এগিয়ে দিলেন কিছুটা রাস্তা ৷ এর মাঝে আর কোন কথা বললেন না ৷ একটা রিকশা পেয়ে চলে এলাম বাসায় ৷
প্রতিদিন বিকেলে কোচিন ক্লাশ শেষে নদীর পাড়ের ঐ বেঞ্চ টা তে গিয়ে বসে বসে বই পড়াটাও আমার একটা রুটিনে পরিণত হয় ৷কারন জায়গাটা বেশ নিরিবিলি ৷ শান্ত নদী, সবুজ গাছ , কেউ বিরক্ত করে না ৷আজ পড়তে পড়তে কখন যে বেলা ফুরলো টের ই পেলাম না ৷ হঠাৎ মায়ের কল পেয়ে হুশ এল ৷
এলবার্ট-ভিক্টোরিয়া আজ বৃষ্টি পেয়ে খুব রোমান্টিক মুডে আছে ৷ কতক্ষণ নাচানাচি করে নিজের হাড়িতে গিয়ে বসেছে ৷ আমি খাচা ঢেকে দিয়ে নিজের রুমে এলাম ৷পরের দিন সকালে জ্বর বেধে গেল ৷ তিনদিন যাবৎ ঘর থেকে বের হই না ৷ সারাদিন এলবার্ট-ভিক্টোরিয়ার কান্ড দেখেই সময় কাটাই ৷ লোকটির কথা ভুলেই গিয়েছি এ কদিনে ৷ পঞ্চম দিন একগাদা কবিতার বই নিয়ে চলে এলাম নদী পাড়ে আবার ৷
--"আকাশে কার বুকের মাঝে ব্যথা বাজে,
দীগন্তে কার কালো আঁখি,
আঁখির জলে যায় ভাসি"
--কি সুন্দর গলা ! ইশ , শুরুটা মিস করে ফেল্লাম !
--আপনি এসেছেন ! আমি তো ভাবলাম আর কখনো দেখা হবে না ৷
--না আসলে তো জানতেই পারতাম না যে আপনি এত ভাল গান জানেন ৷
--হাহাহা ৷ তাই ! সেদিন তো পালিয়েছিলেন ৷আজ কি ভয় লাগছে না আমাকে দেখে?
--কেন ভয় লাগবে ! যে এত সুন্দর করে গান গাইতে পারে , তাকে বরং আমার ভালই লাগে ৷
আজ মনটা খুব ভাল লাগছে ৷ লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম , সম্পূর্ণ তার বীপরীত ৷ অর্ধেক প্রেমেই বোধহয় পরে গেছি ৷ এভাবেই কেটে গেল কয়েকদিন ৷ এখনো কেউ কারো পরিচয় জানিনা ৷একদিন হঠাৎ জিগ্জ্ঞেস করে বসলাম --
--আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?
--না ৷ পড়ালেখার চাপে এসব কখনো মাথায় ই আসেনি ৷ যখন এলো তখন আর সময় নেই হাতে ৷
--মানে?
--আমার নিউকিমিয়া আই মিন ব্লাড ক্যান্সার ধরা পরেছে ৷ প্রথমে কাকা তারপর বাবা চলে গেলেন এই রোগে, এর এক বছর পর মা ও চলে গেলেন ৷ এবার আমার পালা ৷ কয়েক মাস যাবৎ ব্লাড নিচ্ছি শরীরে ৷ ভাবছি মরেই তো যাব , শুধু শুধু অন্যের শরীর থেকে রক্ত কমিয়ে কি লাভ ! পরে যদি ওরা অভিশাপ দেয় ! হা হা হা ৷
মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরল আমার ৷ বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি ৷ হাসিমুখ দেখে একমূহুর্তের জন্যও মনে হয়নি তিনি অসুস্থ ৷
--আপনি সত্যিই অসুস্থ ?
--কই না তো ৷
--দেখুন এসব নিয়ে ঠাট্টা আমার পছন্দ না ৷
--আমি কি বলেছি আমি অসুস্থ ! কেবল ক্যান্সার ধরা পড়েছে মাত্র ৷ মানসিক দিক দিয়ে আমি সুস্থই আছি ৷ হা হা হা ৷
তারছিড়া নাকি লোকটা ! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল ৷ রাগে হনহন করতে করতে বাড়ী ফিরে এলাম ৷ আশ্চর্য্য , পিছন থেকে ডাকলও না একবার ! কিভাবে ডাকবে, আমার নাম ই তো জানেনা ৷ তবুও, এই, এইযে, ওই দাড়াও , এভাবে অন্তত ডাকতে পারতো ! কেন এত কষ্ট লাগছে ! এলবার্ট-ভিক্টোরিয়ার ও আজ বোধহয় মন খারাপ ৷ দুজন অভিমান করে দুদিকে বসে আছে ৷
আচ্ছা, সে মিথ্যা বলল না তো ! সত্যি যদি হয় তবে আগে কেন বলল না ! আমি কি তাকে ভালবেসে ফেলেছি নাকি শুধুই সহানুভূতি ! এভাবে ফেলে চলে আসাটা ঠিক হয়নি ৷ অপরাধবোধ কাজ করছে ৷
পরের দিন চলে গেলাম সেখানে ৷ আমার আগেই এসে বসে আছে ৷
--হাত টা ধরবেন ?
--কেন ?
--মনে করুন শেষ ইচ্ছেগুলোর একটি এটা ৷
--আর কি কি ইচ্ছা পুষে রেখেছেন মনে?
--এইযে কারো সাথে একসাথে বসে চাঁদ দেখবো ৷ সে শাড়ী পরে থাকবে ৷ কবিতা যদিও লিখতে পারিনা ৷ তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে ছন্দহীন একটা কিছু বানিয়ে নেব ৷ আমার জন্য রান্না করে নিজ হাতে খাইয়ে দেবে...............৷
--আপনার ইচ্ছে কেন পূরণ করব আমি ৷
--এই যে এখন একটা গান শোনাব তাই ৷
আমি মুচকি হাসলাম ৷ ভিতরে কেমন চাপা কষ্ট হচ্ছে ৷ বাস্তব জীবনটা কিভাবে এত নাটকীয় হতে পারে বুঝে উঠতে পারছি না ৷ তিনি গান শুরু করলেন -
-যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইবনা,বাইবনা মোর খেয়া তরি এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে-
আমায় তখন নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে ৷৷
আমি তো নিজের চোখের জল ই আর ধরে রাখতে পারলাম না , তাকে কি করে ধরে রাখবো ! শেষ বেলায় এসে কি করে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করব !
______________________________
দুদিন পর :
নিজের হাতে রান্না করে একটা বক্স এ ভরে ,শাড়ী পরে চলে গেলাম ৷ বিকেল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল , সে এল না ৷ তার দেখা আর পাইনি ৷ আর কোনদিন না ৷ সে এখনো বেঁচে আছে কিনা তার ও কোন খোজ পাইনি ৷ বাসায় এসে দেখি খাচার দরজা টা একটু খোলা ৷ এলবার্ট নেই ৷ অনেক খুজলাম, পেলাম না ৷ সেও তার ভিক্টোরিয়ার কাছে ফিরে আসেনি ৷ ভিক্টোরিয়া হয়তো শোক কাটিয়ে উঠেছে, এখন আর এলবার্টের জন্য অপেক্ষা করেনা, নিজেই খাবার খায় আর ডিম দুটোকে আগলে রাখে ৷

No comments

Powered by Blogger.