Header Ads

অসময়ে অস্ত গেল রবি

ছোট মফস্বল শহর।শহর হলেও অনেকটা গ্রামের মতই পরিবেশ এখানে।সুখে দুঃখে একে অপরের খোঁজ খবর রাখে আবার মনকষাকষিও হয়।যতই বিজলী বাতি থাকুক চাঁদের জ্যোতির কমতি নেই।রাত ১১টা বাজার আগেই অধিকাংশ বাড়ির আলো নিভে যায়।চাঁদ তাঁরা তখন সৌন্দর্য প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতা শুরু করে।
এই মফস্বল শহরেই রথীন্দ্রনাথ কাকার বাড়ি।বিয়ের ১২ বছর পরেও রথীন দম্পতির ঘরে কোন নতুন মুখের হাসি উঁকি দেয়না।ইতোমধ্যে অনেক ডাক্তার,কবিরাজ ফকির, দরবেশ,হুজুর এবং সাধু কোনটাই বাদ রাখেননি এই দম্পতি। কত পূজা মানত করেছেন তা কেবল তারাই জানেন।অবশেষে বিয়ের ১৮ বছর পর রথীন কাকার স্ত্রী অনুপমা কাকির গর্ভে কাকার ঔরসজাত সন্তান আমাদের সবার প্রিয় ভাইয়ের আগমন হয়।কাকার পুত্রসন্তানের জন্মের বারটা ছিল রবিবার।জন্মের সময়টাও ছিল উদীয়মান রবির মুহুর্ত। ভরানী নক্ষত্র তিথিতে জন্মানো মীনরাশির জাতকের নাম কাকা কাকিমা শখ করে রাখেন "উদয় রবি"
যেদিনের কথা ও ব্যথা শেয়ার করতে আমি এলাম সে দিনটাও ছিল রবিবার।টিউশনি সেরে বাসায় ফিরছিলো ভাই।কাকার সচ্চল অবস্থা থাকা সত্বেও টিউশনি করত আমার ভাইটি।অলসভাবে সময় কাটানো অভ্যাস তার মোটেও ছিলনাযে।
আসলে আর্থিক অবস্থার জন্য নয় নিজের সচ্চলতার জন্য,দেশের উন্নতির জন্য সবার উপার্জনক্ষম হওয়া উচিৎ।
রবি পিচঢালা যে পথদিয়ে ফিরছিলো তার বাম পাশে থানা।ডানপাশে পশু হাসপাতাল। তারপরেই উপজেলা কার্যালয় এবং বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অফিস।তার পরপরই কলেজ।কলেজ থেকে ২০ হাতের মত দুরে একখানি সরু বাগান।বাগানের পাশেই দুজন উঠতি বয়সের যুবক রবিউল ও অনল চন্দ্র দাড়ানো।রবি তাদের কাছাকাছি হতেই রবিউল বলে ওঠে কিরে দোস্ত কোথা থেকে এলি??
রবির শান্ত ও নির্লিপ্ত উত্তর।
-টিউশনি থেকে এলাম। কিন্তু তোরা এখানে এতরাতে??
অনলচন্দ্রর জবাব কিসব বলছিস রবি মাত্রতো দশটা বাজে।
-তা টিউশনিতে গিয়ে ছাত্রীর সাথে কি কি করলি??(রবিউল)
অবাক চোখে এবং মুখে রাজ্যির বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে রবি।
আহা ভাজা মাছটাও যেন উল্টে খেতে জানেনা (অনল)
রবি কোন কথা না বলে সামনে এগুতে যায়।ঠিক সেই মুহুর্তে বাগান থেকে শংকর,হিজবুল ও রওনক এসে জাপটে ধরে রবিকে।
রবি অবাক হয়।
-একি তোরা আমায় এভাবে ধরছিস কেন??
হিজবুল রবিকে এক ধাক্কা মেরে বলে
-এই কুত্তা টিউশনির নামে মেয়েদের ব্লাক মেইল করিস??প্রেম নিবেদন করিস?
বেড শেয়ার করতে বলিস?
এই তুই রওনকের গার্লফ্রেন্ড শায়লাকে কি বলোছিস??
-আমি কিছু করিনি। তোরা বিশ্বাস কর।
শংকর রবিকে এক ঘুষি মেরে বলে
- বলিসনি তবেকি রওনক মিথ্যে কথা বলছে?
রওনক রবির কানের পাশে চড় মেরে বলে
-এই তুই বলিসনি কিছু তাইনা?
তুই বলিসনিযে, শায়লা তুমি আমার সাথে প্রেম করো।তুমি আমার সাথে থাকো।রওনক তোমার সাথে যা করে আমি তাই করব।তোমায় রওনকের থেকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে চুমু খাবো।
-আমি ওসব কিছৃই বলিনি।বলেছে তোর বন্ধু রবিউল রবি।আমি উদয় রবি নই।
রবিউল আর শংকর রবির মাজা বরাবর লাথি মেরে বলে,
- এই তুই যা যা বলেছিস তার সব প্রমাণ আছে। ফেসবুক ম্যাসেন্জারের সমস্ত স্ক্রীনশর্ট আমাদের কাছে আছে।
-ওসব স্ক্রীনশর্ট বানোয়াট।তোরা আমার ছবি লাগিয়ে ভূয়া আইডি খুলে ওসব বানিয়েছিস।
রবির কোন কথা শুনতে রাজি নয় তারা।মারতে মারতে মাটিতে শুইয়ে দেয় ওরা আমার ভাইকে।এক এক করে বলতে থাকে
-ব্যাটা ইভটিজিং করিস?শায়লাকে দেখে শিস মারিস তাইনা??আর ঐ পাড়ার বনানীকে কি বলেছিস?ওর গায়ে তোর হাত দিতে মন চায় তাইনা?
নিজে অন্যায় করে অন্যের দোষ দিস আবার তাইনা?
রবিকে ওরা এলোপাথাড়িভাবে মারতে থাকে ওরা।আজকাল কোথাও মেয়েদের কিছু বল্লেই ঝাপিয়ে পড়ে।ব্যাপারটা কতখানি সত্যি তা কেউ খতিয়ে দেখার দরকার মনে করেনা।যাকে দোষী করা হচ্ছে সে দোষী কিনা কেউ তা দ্যাখেনা।
আমাদের শান্ত-শিষ্ট উদয় রবিও এমন পরিস্থির শিকার।
রবির পাড়াতো দিদি হয়েও আমি জানিনা রবির এই নির্যাতনের নেপথ্যে কি ছিল।হতে পারে রবির লেখাপড়ায় ও সৃজনশীল কাজে অসামন্য সাফল্য অথবা তার বাবার সম্পত্তি।
এলোপাথাড়ি মার খেয়ে বাড়ি ফেরে রবি।তাকে দেখে তার বাবা মা দুজনই আঁতকে ওঠে।এক সাথেই বলে ওঠেন
-কি হয়েছে বাবা?
- কিছু হয়নি মা।কিছু হয়নি বাবা। ভ্যান উল্টে বৈরাগীদের ভিটের ওখানে পড়ে গিয়েছিল আমি সেই ভ্যানে ছিলাম।এছাড়া আর কিবা বলতে পারে রবি?বাবা-মা বড় আঘাত পাবেন।কাল সকালে জানাজানি হবে।প্রতিবেশী সবাই বিশ্বাস করে নেবে রবি ইভটিজার।খবরের কাগজের শিরোনাম হবে রবি একজন ইভটিজার।সারা শহরে ঢিঢি পড়বে।শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে এই মিথ্যা প্রমাণগুলো।রবির শাস্তি চেয়ে মিছিল মিটিং হতে পারে।পাবলিক এখন নারী আন্দোলনে বড়ই সোচ্চার।ফেসবুকে স্ট্যাটাসের বন্যা বয়ে যাবে।প্রগতিশীল প্রযুক্তির এই যুগে বানোয়াট ঐ স্ক্রীনশর্টগুলো পৌঁছেযাবে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। কেউ ভাববেনা প্রযুক্তির অপব্যবহার করে কত অন্যায় এখন করা যায়।মানুষ হুজোগে মাতে বেশী। গভীরে ভাবেনা।এসব ভাবনাতে দম বন্ধ হয়ে আসে রবির।
বাবা মা দুজনই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে।মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠেন যা বাবা ঘরে যা।আমি একটু পরে খেতে ডাকছি। মা ছেলের পছন্দের খাবার বানাতে ব্যস্ত।বাবা এই রাতেও বাগানে কচু তুলতে যায়।ছেলে বড় ভালবাসে কচু।তাছাড়াও আজ এ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ব্যথায় কিছু খেতে চাইবেনা হয়ত।তাই পিতা-মাতা এত আয়োজনে ব্যস্ত।
এভাবে কেটে যায় দুই ঘন্টা।অনুপমা কাকিমা ভাইকে ডাকে।ভাই আমার দরজা খোলেনা।কাকাও ডাকে ভাই তবু দরজা খোলেনা।অবশেষে রথীনকাকা ও তাঁর ভাই দরজা ভাঙেন। হায়রে এতো দরজা ভাঙা নয় হৃদয় ভাঙা।দেহটা শূণ্য করে সোনার ময়না পাখি শূণ্যে ভাসছে।ঘাড়টা একপাশে হেলানো।জিহ্বা বের করা।ঘরের আঁড়ার সাথে ঝুলছে রবি।নিথর দেহ বাইরের ঝড়ো বাতাসে দুলছে একটু একটু করে।
রবির আপন কাকা রবির গায়ে হাত দিয়ে দ্যাখে তাদের ছেলের জীবনের রবি চিরোদিনের মত অস্ত গেছে।বড় ঠান্ডা আমাদের রবির শরীর। ঠিক যেন শীতের সূর্যাস্ত শেষে ঠান্ডা কনকনে শীতরাত্রি।
By Shibani Mondal

No comments

Powered by Blogger.