Header Ads

ব্যাপারটা ভূতুরে

কদিন ধরে শরীর ভালো যাচ্ছে না তার। ঝামেলা
শুধু এটাই নয়, ঝামেলা আরও আছে।
প্রচুর কাজ জমেছে আঁকিয়ের হাতে। তিনি যে
পত্রিকায় কাজ করেন সেখানকার কাজের চাপে
অন্য কাজে হাত দিতে পারছিলেন না। তার ওপর
গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। এই শহরটায় যেন একটু
বেশিই গরম। আঁকিয়ের পত্রিকা অফিসে একজন
জাঁদরেল রিপোর্টার আছেন। রিপোর্টে
একদম গভীর থেকে সত্য ঘটনা তুলে
আনেন। গত মাসেই তো, হ্যাঁ, গত মাসেই তার
একটা রিপোর্টের সূত্র ধরে একজন ভয়ংকর
খুনী ধরা পড়ল। অথচ বহুদিন ধরে পুলিশ এই
খুনীকে খুঁজছিল। তো সেই জাঁদরেল
রিপোর্টার পেশার ক্ষেত্রে জাঁদরেল হলে
কী হবে, মানুষ হিসেবে দারুণ রসিক। তাকে
দেখে মনেই হবে না তার হাতে এমন কঠিন
রিপোর্ট তৈরি হয়! সেদিন অফিসে কয়েকজন
মিলে গল্প-গুজব করতে করতে গরমের
প্রসঙ্গ উঠেছিল। গরমে অতিষ্ঠ আঁকিয়ের
মুখের দিকে তাকিয়ে জাঁদরেল রিপোর্টার চট
করে এক মজার কথা বললেন- ‘বুঝলেন,
মানুষগুলো শহরটাকে এতই বিরক্ত করছে,
শহরের ভীষণ মাথা গরম। তাই শীতকালেও ততটা
ঠাণ্ডা পড়ে না এই শহরে।’
রিপোর্টারের কথায় ভারী মজা পেল সবাই। কথাটা
আঁকিয়েরও খুব মনে ধরেছে। সে ভাবেÑ তাই
তো, অফিসে যাতায়াতে তার কী যে কষ্ট!
ঘেমে-নেয়ে একাকার। গরম আর অফিসের
কাজের ক্লান্তি মিলিয়ে বাসায় ফিরে একদম শরীর
ছেড়ে দেয়। তখন অন্য কাজে মন বসে কার?
আঁকিয়ে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারেনÑ তার
মতো অন্যদেরও এই পরিস্থিতিতে কাজে মন
বসবে না। তাই তো জমে থাকা কাজগুলোয় আজ
হাত দেই, কাল হাত দেই করে হয়ে উঠছিল না।
এরমধ্যে আবার জ্বর। টানা এক সপ্তাহ জ্বরে
ভুগে ডাক্তারের দেয়া এন্টিবায়োটিক খেয়ে
আরো নাজুক অবস্থা আঁকিয়ের। হবে না? রোগ-
জীবাণু মরুক আর যা-ই করুক, যুদ্ধটা তো তার
শরীরের ভেতরে! লক্ষ-কোটি জীবাণুর
বিরুদ্ধে ওষুধের লড়াই।
এসবে ভীষণ নাজুক অবস্থা আঁকিয়ের।
এদিকে পড়ে থাকা কাজগুলোর জন্য প্রকাশকের
রাতদিন তাগিদ। প্রতিদিন সকাল-বিকাল দুবার ফোন
করেন প্রকাশক। কতগুলো ভূতের গল্প নিয়ে
একটা বই বের করতে চাচ্ছেন তিনি। কদিন পরেই
স্কুলগুলোতে গরমের ছুটি। এই সময়ে বইটা
বাজারে ছাড়তে চান। গরমের ছুটি কাটাতে
ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই এই মজার বইটা লুফে
নেবে! তাই আঁকিয়েকে এমন জোর তাগিদ
দেয়া। তাছাড়া অনেক দিন আগে পাণ্ডুলিপিটা
আঁকিয়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেছেন
প্রকাশক। আঁকিয়ে প্রতিটি ভূতের গল্পের একটি
করে ছবি এঁকে দেবেন। চমৎকার একটা প্রচ্ছদ
করে দেবেন।
কিন্তু অনেক দিন গড়িয়েছে, আঁকিয়ে কাজটাতে
হাত দিতে পারছেন না।
আজ সকালে প্রকাশক ফোন করে অনেক
আকুতি করে বলেছেন দুদিনের মধ্যে কাজটা
শেষ করে দিতে। নইলে বইটা আর বাজারে
দিয়ে লাভ হবে না।
ব্যাপারটা আঁকিয়ের ভাবনাতেও কড়া নাড়ল। নাহ্, কাজটা
আর আটকে রাখা ঠিক হচ্ছে না। কদিন পরেই
তো স্কুলগুলোতে গরমের ছুটি শুরু হয়ে
যাবে। বইটা সময় মতো বাজারে দিতে না পারলে
বেচারা প্রকাশকের ক্ষতি হয়ে যাবে। আঁকিয়ে
ভাবলেনÑ যেমন করে হোক দু’দিনের মধ্যে
কাজটা শেষ করবেন। অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যা
থেকে বসলেই অনেকটা কাজ এগোবে।
দরকার হলে একটু রাত জাগবেন। তবু দুদিনের
মধ্যে কাজটা শেষ করা চাই। একটা কাজ অবশ্য
এগিয়ে রেখেছেন আঁকিয়ে। জ্বরের মধ্যে
গল্পগুলো পড়ে রেখেছিলেন। এখন শুধু
গল্প ধরে ধরে ছবিগুলো এঁকে ফেললেই
চলবে।
সন্ধ্যা থেকে কাজটা নিয়ে বসলেন আঁকিয়ে।
রাতের খাবারে ডাক পড়ার আগ পর্যন্ত পাঁচটা
গল্পের ছবি এঁকে ফেললেন। না, তেমন
ক্লান্তি অনুভব করলেন না।
খাওয়া শেষ করে খানিকক্ষণ বাসার সামনের খোলা
জায়গায় হেঁটে এলেন আঁকিয়ে। রাতের খাবারের
পর এটা তার প্রতিদিনের অভ্যেস। অভ্যাসটা
শরীরের জন্যও ভালো। হজমে সহায়ক হয়।
ভীষণ রকম আটকে না গেলে সচরাচর
আঁকিয়ের এই অভ্যেসে রদবদল হয় না।
হাঁটাহাঁটি শেষ করে ফিরে এসে এক গ্লাস পানি
খেয়ে শরীরের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা
করলেন আঁকিয়ে। নাহ্, ক্লান্তি জাঁকিয়ে বসেনি
এখনও। আরও কিছুক্ষণ কাজ করা যায়। অতএব কাজে
লেগে গেলেন। কাজ করতে করতে
আঁকিয়ে দেখলেন একটু রাত জাগলে পুরো
কাজটা শেষ করা যায়। কাল না-হয় একটু দেরিতে ঘুম
থেকে উঠবেন। তবু টেনশন থেকে তো
উদ্ধার পাওয়া যাবে।
কাজ শেষ করতে করতে বেশ ঘুম পেয়ে
গেল আঁকিয়ের। একটা গল্পের ছবি তখনো
বাকি।
আঁকিয়ে ভাবলেনÑ একটাই তো গল্প,
সকালবেলা এঁকে ফেলা যাবে। তাছাড়া এই গল্পটার
ছবিটা ঠিক কেমন হবে বুঝে উঠতে পারছেন না!
গল্পটা যদিও পড়া আছে। আঁকিয়ে ভাবেনÑ
ঘুমাতে ঘুমাতে গল্পের ছবিটা নিয়ে চিন্তা করা
যাবে। নিশ্চয়ই একটা কিছু পেয়ে যাবেন। তারপর
সকালে উঠে এঁকে ফেললেই চলবে। একটা
মাত্র ছবি! ভাবতে ভাবতে বেশ তৃপ্তি বোধ
করলেন আঁকিয়েÑ যাক, কাজটা তাহলে শেষ করা
গেল। কালই প্রকাশককে ডেকে কাজটা দিয়ে
দেবেন। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে
পড়েছিলেন আঁকিয়ে। ঘুম আসবে না আবার! এক
রাতের মধ্যে এতগুলো গল্পের ছবি আঁকা কি
চাট্টিখানি কথা!
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আঁকিয়ের।
ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলেন। ঘরে চোর-
টোর ঢুকল না তো! ঘুমের মধ্যে অদ্ভুত সব
শব্দ টের পাচ্ছিলেন আঁকিয়ে। তাই ঘুমটা ভেঙে
গেল।
আলো জ্বালিয়ে সারাঘরে দৃষ্টি বুলালেন। মনের
সন্দেহ থেকে ড্রয়িংরুমেও গেলেন। নাহ্,
কোথাও কিছু চোখে পড়ল না। তাই নিজের ঘরে
এসে এক গ্লাস পানি খেয়ে আলোটা নিভিয়ে
আবার শুয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে
ভাবলেনÑ একে তার দুর্বল শরীর, তার ওপর রাত
জেগে কাজ করায় শরীরের ওপর বেশ চাপ
পড়েছে। তাই হয়তো এসব এলোমেলো
¯^প্ন দেখেছেন! ভাবতে ভাবতে আবার
ঘুমিয়ে পড়লেন আঁকিয়ে।
আবার সেই শব্দ। এবার শুধু শব্দই নয়, আঁকিয়ে
অনুভব করলেন পুরো বাড়িটা যেন কেঁপে
উঠল! দেয়াল ভেঙে কেউ যেন ঘরে এসে
ঢুকল! ভয়ে ভয়ে চোখ মেললেন আঁকিয়ে।
অন্ধকারেই চোখ দুটোকে পুরো ঘরটায়
ঘুরিয়ে নিতে গিয়ে চমকে উঠলেন। বুক
কেঁপে উঠল তার। ঘরের ভেতরে বিশাল
পাহাড়ের মতো একটা কিছু স্থির হয়ে আছে।
আবার মাঝে মাঝে নড়েচড়ে উঠছে। তখনই
কেঁপে উঠছে বাড়িটা। এ কী, রাক্ষস-টাক্ষস নাকি!
আঁকিয়ের বুক ঢিপঢিপ। তিনি চোখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি
বুলাতেও ভয় পাচ্ছেন। তার চোরাদৃষ্টি যদি ঐ ছায়া
ছায়া রাক্ষসটার চোখে পড়ে যায়, কী হবে
তাহলে!
ঘরের মধ্যে কারও ভারী নিঃশ্বাস ওঠা-নামার শব্দ
টের পেলেন আঁকিয়ে। নিঃশ্বাস তো নয়, যেন
শো শো শব্দে কালবোশেখি তেড়ে
আসছে!
শব্দটা যতটা না জোরালো, রাতের সুনসান
নীরবতায় তা খুব বেশি গম্ভীর শোনালো।
ঘুমের ঘোরে শব্দটা আরও জোরালো মনে
হচ্ছিল।
একটু ভয় ভয় লাগছে আঁকিয়ের। নড়াচড়া না করে
লম্বা হয়ে শুয়ে থাকলেন। টের পেলেনÑ
ঘরের ভেতরে কিছু একটা ঘটছে।
একটুক্ষণ পর আবার আগের অবস্থা হলো- ঘরটা
কেঁপে উঠল। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে! আঁকিয়ে
এবার বেশ ভয় পেলেন। ধড়ফড় করে বিছানায়
উঠে বসলেন। অমনি মনে হলোÑ কেউ যেন
গভীরভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরল তাকে।
অনুভূতিটা ¯^াভাবিক মনে হলো না। যেন রশি দিয়ে
বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে, এমন অনুভূতি। এতটাই
আষ্টেপৃষ্ঠে রেখেছে, মনে হলো তার
শরীরের হাড়গোড় যেন ভেঙেচুরে
আসছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ভয়ে চিৎকারও
করতে পারছেন না।
যেন শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
সব মিলিয়ে বেহাল অবস্থা। এমন মুহূর্তে কারো
কথা শুনতে পেলেন আঁকিয়ে! নীরব ঘরটাতে
কথাগুলো দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে
গমগম শব্দে ভেসে বেড়াতে লাগল। একটু
থেমে আবার এমন শব্দ। তারপর আবার। আঁকিয়ে
বুঝে উঠতে পারলেন না কিছুই। এদিকে ভয়ে
জড়োসড়ো অবস্থা তার। ঢোঁক গেলার মতো
আঁকিয়ের গলা থেকে একটা মাত্র শব্দ
বেরোলো-- ‘কে?’
অমনি আগের মতোই গমগম শব্দ হলো।
কোনো অচেনা কণ্ঠ বলে উঠল- আমাকে
চিনতে পারিসনি বোকা!
‘না। কে তুমি?’ কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন
আঁকিয়ে।
‘ভেবে দ্যাখ্, চেনা যায় কিনা।’
আঁকিয়ে একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। চুপ করে
থাকা ছাড়া কী আর করার আছে তার? কী আর
ভেবে বের করবেন?
শব্দটা আবার হলোÑ কী, চিনতে পারছিস না, তাই
তো?
অসহায় গলায় আঁকিয়ে বললেন, না।
এবার যেন শব্দটা কাচের পাত্র ভাঙার মতো
ঝনঝন করে বাজলÑ নাহ্, একদম ভালো করিসনি।
তোকে সময় দিলাম, ভেবে দ্যাখ। এই সময়ের
মধ্যে ভেবে বের করতে না পারলে আমি
আবার আসব।
একটুক্ষণ পর আঁকিয়ে টের পেলেন
নিজেকে বেশ ¯সাভাবিক লাগছে তার। একটু
আগেও তার মনে হচ্ছিলÑ কেউ যেন তাকে
আষ্টেপৃষ্ঠে রেখেছে! এখন আর তা মনে
হচ্ছে না। ঘরের ভেতরে শো শো শব্দটা
নেই। আঁকিয়ে অনুভব করলেন তার ভেতরের
ভয় ভয় ভাবটাও আর নেই। নিজেকে বেশ হালকা
লাগছে তার। বিছানা ছেড়ে নামলেন তিনি। সুইচ
টিপে আলো জ্বেলে কী ভেবে পুরো
ঘরটাতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলেন একবার। তারপর
গ্লাসে পানি ঢাললেন। সবটুকু পানি এক নিঃশ্বাসে
শেষ করে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে টেবিলের
কাছে গেলেন। ছবি আঁকার কাগজ আর রং-তুলি
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে টেবিলে। আঁকিয়ের
কেন যেন মনে হলো বাকি ছবিটা আঁকতে
পারবেন এখন। গল্পটার ছবিটা যেমন হওয়া উচিত,
তেমন একটা ছবি তার মগজে ঘুরপাক খাচ্ছে। ছবিটা
আঁকতে শুরু করলেনÑ আবছা অন্ধকারে ছায়া ছায়া
কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। ছায়াটা কি ভূতের?
হ্যাঁ, এখন আঁকিয়ে বেশ আঁকতে পারছেন শেষ
গল্পের ছবিটা। ছবিটা আঁকতে আঁকতে একটু
আগের ঘটনাটা চোখে ভাসল আঁকিয়ের। তার
আঁকিয়ে জীবনে কখনও এমন ভুতুড়ে ব্যাপার
ঘটেনি।

No comments

Powered by Blogger.